শেয়ার বিজ ডেস্ক: গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হলে ম্যাক্স ও তার স্ত্রী জার্মানি থেকে পোল্যান্ডে পাড়ি জমান। এরপর তারা সীমান্ত পেরিয়ে ইউক্রেনে প্রবেশ করেন। আতঙ্কভরে তারা দেখতে থাকেন ইউক্রেন ছেড়ে পোল্যান্ডে পালিয়ে যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ, অথচ তারা বিপরীতমুখী হয়ে প্রবেশ করছেন। পথে ডজনখানেক সামরিক চৌকি, রাস্তায় ট্যাঙ্কের চলাচল ও বালির বস্তা দেখতে পান। জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি তারা। তবু তারা ফিরে যেতে চান না। কেননা এই ইউক্রেন তাদের দশ বছরের লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে চলেছে তারা মা-বাবা হতে চলেছেন। তাদের ইউক্রেনীয় সারোগেট মা শিগগির যমজ কন্যাসন্তানের জন্ম দেবেন। খবর: গার্ডিয়ান ও নিউইয়র্ক টাইমস।
যুদ্ধ শুরুর নয় দিনের মাথায় ৪ মার্চ তাদের সন্তানরা পৃথিবীতে আসে। তাদের হাসিমুখ এই দম্পতিদের সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। তবে বোমাবর্ষণ, গোলাগুলি, সাইরেন, যুদ্ধবিমানের আনাগোনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের হাসপাতালের বেজমেন্টে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। ম্যাক্স বলেন, মানুষ মারা যাচ্ছেন, শহরগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। কবে চারজন একত্রে নিরাপদে দেশে ফিরতে পারব জানি না।
তাদের মতো সন্তান নিতে ইচ্ছুক আরও অনেক বিদেশি দম্পতি ইউক্রেনে আটকা পড়েছেন। প্রায় প্রতিদিন দেশটির সারোগেট মায়েরা কোনো না কোনো বিদেশি দম্পতির সন্তান জন্ম দিচ্ছেন এবং তাদের মা-বাবারা অনাগত সন্তানদের ছেড়ে দেশটি ছাড়তে পারছেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের এক দম্পতি দশ বছর অপেক্ষার পর হাল ছেড়ে দিয়ে সারোগেসির দ্বারস্থ হয়েছেন। কানাডার এক দম্পতির সন্তান সম্প্রতি কিয়েভের একটি হাসপাতালে জš§ নিয়েছে। তারা বর্তমানে সন্তানকে কাছে পাওয়ার আশায় তুরস্কে অবস্থান করছেন। তাদের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনী নিঃসন্তান দম্পতিরা একটি সন্তানের আশায় কয়েক বছর ধরে অর্থ ও ভূগোল যেন এক করে ফেলছেন। সন্তানহীন অনেক দম্পতি তাই নিজ দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেনে। সারোগেসি (গর্ভ ভাড়া) পদ্ধতিতে সন্তানসুখ উপভোগ করতে চান তারা। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কেমন আছে এ সময়ের মধ্যে জš§ নেয়া শিশুগুলো? তাদের সারোগেট মায়েরা কোথায় রয়েছেন? ভিনদেশে বা এই মহূর্তে ইউক্রেনে থাকা তাদের বাবা-মায়েরাই বা কেমন আছেন?
মা-বাবা হওয়ার এই বিজ্ঞানসম্মত সারোগেসি পদ্ধতিতে সন্তান জš§দানে কয়েক বছর ধরে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে ইউক্রেন। বিষয়টিকে বাণিজ্যিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে দেশটি। সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম বাবা-মায়েরা সারোগেসির মাধ্যমে আত্মজ-আত্মজার স্বপ্নপূরণ করছেন এ দেশে। বন্ধ্যত্বের বাধা পেরিয়ে মাতৃত্বের স্বাদ পেতে ভরসা সারোগেসি। এজন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। ন্যায্যদাম পেলে সন্তান ধারণের এমন কোনো পরিষেবা নেই, যা পাওয়া যায় না ইউক্রেনে। দেশটির এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিদেশি বাবা-মায়েদের জন্য প্রতি বছর সারোগেসি প্রক্রিয়ায় অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার সন্তানের জš§ হয় দেশটিতে। আর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সন্তান ধারণের এই ‘পদ্ধতি’ এখন বিশ্বে ৫০০ কোটি ইউরোর বেশি। সাধারণত ইউক্রেনে সারেগেসির মাধ্যমে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ন্যূনতম খরচ ৪০ হাজার ইউরো। এ খরচ বাড়তে পারে ৭০ হাজার ইউরো পর্যন্ত। শিশুপ্রতি ১৫ হাজার ইউরো দেয়া হয় সারোগেট মাকে। চাইলে পুত্র বা কন্যাসন্তানের জন্যও চেষ্টা করতে পারেন সন্তানেচ্ছুক বাবা-মায়েরা। তবে যে ধাত্রী-মায়েদের ওপর ভর করে ইউক্রেনের এই বাণিজ্যিক সাফল্য তাদের অভিযোগ, সন্তান ধারণের পারিশ্রমিক মাঝেমধ্যে দেয়া হয় না। তাদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হয়। অনেক সময় তাদের মানসিক সহায়তা করা হয় না বলে জানান ৩২ বছর বয়সী সারোগেট মা ইয়ানা বেলেজোর।
ইউক্রেনে ১৪টি সারোগেসি ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী কিয়েভের ক্লিনিক বায়োটেক্সকমে দেশের অর্ধেক সারোগেসি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এখানে বছরে এক হাজারের বেশি সন্তান জন্ম দেয়া হয়। এই ক্লিনিকে চলতি মাসে ১০০টি সন্তান জন্ম নেয়ার আশা করা হচ্ছে। তাদের মা-বাবারা সীমান্তে সন্তানদের জন্য অপেক্ষা করছেন। বায়োটেক্সকমের স্বত্বাধিকারী অ্যালবার্ট টকিলোভস্কি বলেন, বেজমেন্ট ক্লিনিক চালিয়ে নেয়া কষ্টকর। এই মুহূর্তে ১০০ মা রয়েছেন এখানে। তাদের ও অনাগত সন্তানদের যতœ নেয়ায় ত্রুটি রাখা হবে না বলে জানান তিনি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর দেশটিতে শত সারোগেট মা ও শিশু আটকা পড়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন দেশ-বিদেশের অনেক দম্পতি। তাই সন্তানের জন্য ব্যাকুল দম্পতিরা ভীষণ যন্ত্রণার মধ্যে সময় পার করছেন। কেননা তাদের অনেকে দেশটিতে প্রবেশ করতে পারছেন না। নবজাতকদের নিরাপত্তার জন্য কিছুই করতে পারছেন না, তাদের সরিয়ে নিতেও পারছেন না। এ ছাড়া ইউক্রেনে চিকিৎসা নেয়া দম্পতিদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সারোগেটের মাধ্যমে দুই সপ্তাহ আগে এক ব্রিটিশ দম্পতির যমজ সন্তান হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নবজাতকসহ তারা কিয়েভে আটকা পড়েন। বোমা হামলার প্রথম দিন তাদের সন্তানদের ইউক্রেনের জš§নিবন্ধন দেয়ার কথা ছিল। মা আনাবেল (ছদ্মনাম) বলেন, কিয়েভে যুদ্ধের ঠিক মাঝখানে আমরা ছিলাম। সেট খুবই ভয়াবহ ছিল। পরে তারা সন্তানসহ পোল্যান্ডে পৌঁছাতে সক্ষম হন। তাদের মতো বিভিন্ন দেশের অনেক দম্পতি একই সমস্যায় পড়েছেন। এ মুহূর্তে যুক্তরাজ্যের প্রায় ৪০ দম্পতির একজন করে সারোগেট মা তাদের সন্তান বহন করছেন। এ ছাড়া ১৩০ জনের ভ্রƒণ সংরক্ষণ করা হয়েছে। তারা ইউক্রেনে চিকিৎসার জন্য যেতে পারছেন না। মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছেন তারা।
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক গ্রোয়িং ফ্যামিলিজের বৈশ্বিক পরিচালক স্যাম এভারিংহাম জানান, তার কাছে ৭০ জন সারোগেট মায়ের তালিকা রয়েছে। তারা অন্তঃসত্ত্বার নানা পর্যায়ে রয়েছেন। তাদের দেশ থেকে বের করে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্রিটিশ ফার্টিলিটি আইনজীবী নাটালি গ্যাম্বল বলেন, আমরা ২৩ দম্পতির সারোগেট মায়েদের যুক্তরাজ্যে আনার চেষ্টা করছি। অন্যথায় কী হবে মায়েদের ও সন্তানদের? তাদের কি যুদ্ধক্ষেত্রেই থাকতে হবে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি এই আইনজীবী। নিউ হোপ সারোগেসির মতো কিছু সংস্থা সারোগেট মায়েদের দেশটির নিরাপদ অঞ্চল কিংবা দেশের বাইরে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। তবে ভিনদেশে সন্তান জন্ম দিলে সেই দেশের আইন মেনে চলতে হবে, যাতে প্রকৃত মা-বাবারা আইনানুযায়ী সন্তান নাও পেতে পারেন। এ ছাড়া তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে ঝামেলা হতে পারে।
হামলা শুরুর প্রথম দিন কিয়েভ ছেড়ে ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলের এক শহরে পরিবারসহ পালিয়ে যান সারোগেসি আইনজীবী ওলগা দানচঙ্কো। সেই থেকে নিঃসন্তান দম্পতির ফোন ও ই-মেইল রিসিভ করতে পারছেন না তিনি। এতে হতাশ হয়ে পড়েছেন যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের দম্পতিরা। যোগাযোগের পরিস্থিতি হলে ওলগা জানান, একের পর এক ফোনকল ও ই-মেইল পাচ্ছি। সবাই তাদের সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন কিন্তু কেউ জানতে চান না, এই যুদ্ধের মধ্যে আমরা কেমন আছি। তিনি জানান, এই মুহূর্তে প্রায় ৫০০ সারোগেট মা রয়েছেন ইউক্রেনে, যারা বিদেশিদের সন্তান ধারণ করেছেন।