মাঠের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত কৈশোর

কাজী ফারহানা ইসলাম: দিনে দিনে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত খেলাধুলার উপযোগী মাঠ হারিয়ে যেতে বসেছে। তার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত শৈশব ও তারুণ্যের উদ্যম।

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ডিজিটাল ডিভাইসমুখী হয়ে উঠেছে আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজ। অপরপক্ষে চোখের সামনে দিন দিন একের পর এক মাঠ নানাভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

রাজধানীতে যদিও কিছু খেলার মাঠ আছে, তবে এর অধিকাংশই ব্যবহারের অযোগ্য। কোনো না কোনোভাবে মাঠগুলো দখল হয়ে গেছে, আবার কিছু কিছু মাঠ সরকারি উন্নয়নকাজের জন্য নেয়া হলেও কাজ শেষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়নি নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠান। এর ফলে অধিকাংশ ব্যবহার-অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। আবার বেশকিছু মাঠে প্রকাশ্যে মাদক সেবন ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে সর্বসাধারণকে মাঠগুলো ব্যবহার করতে বাধা দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এই অবস্থা থেকে খেলার মাঠগুলোকে সংস্কার ও দখলমুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।

খেলাধুলা শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু খেলার মাঠের স্বল্পতার ফলে শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বিকাশ অনেকাংশে ব্যাহত হচ্ছে।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার প্রাদুর্ভাবে যখন সবকিছু বন্ধ, তখন শিশু-কিশোররা গৃহবন্দি অবস্থায় হাঁপিয়ে উঠেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোয় তাদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে অবশ্যই খেলার মাঠগুলো পুনরুদ্ধার করে একটি স্বাভাবিক ও সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে হবে তাদের বেড়ে ওঠার জন্য।

গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, যেখানে প্রতি পাঁচ হাজার মানুষের বিপরীতে একটি মাঠ থাকার কথা, যার আয়তন হবে এক একর, সেখানে রাজধানীতে বসবাসকারী সোয়া এক কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজন আড়াই হাজার মাঠ, যার এক ভাগ মাঠও রাজধানীতে নেই।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী রাজধানীতে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ২৩৫টি মাঠ রয়েছে, যার মধ্যে ৪২টি সর্বসাধারণ ব্যবহার করতে পারে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছে ১৪১টি মাঠ। ঈদগাহ মাঠ রয়েছে ১২টি। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ৫৫টি ওয়ার্ডে কোনো মাঠ নেই।

রাজধানীতে ৪০টির মতো সরকারি মাঠ রয়েছে, যার মধ্যে ১৬টি মাঠ দখল করে নেয়া হয়েছে। বাকি ২৪টি মাঠ এখনও উম্মুক্ত থাকলেও সেগুলো ব্যবহার-উপযোগী নয়। দুটি সিটি করপোরেশনের ১৬টি মাঠের ছয়টি উত্তরের ও ১০টি দক্ষিণের। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগেরই উন্নয়ন কাজ চলছে, যার ফলে ওইসব মাঠে খেলাধুলার সুযোগ নেই বললেই চলে। তবে কিছু মাঠ আছে খুব ছোট, সেখানে বড়রা খেলার সুযোগ পেলেও খেলার সুযোগ পায় না ছোটরা। আবার কিছু কিছু মাঠে খেলার সুযোগ সবার জন্য নয়। আর এই খেলার মাঠের অপর্যাপ্ততার কারণে ঘরবন্দি হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা।

পাথরের রাজ্য সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ। দীর্ঘদিন এই উপজেলায় পাথর ও বালিখেকোদের ধ্বংসযজ্ঞের ফলে বসবাস-অনুপযোগী হয়ে উঠেছে এলাকাটি। তারা যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, সেখানেই জায়গা দখল করে তৈরি করেছে ক্রাশার মিল বা রাখছে বালি। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি উপজেলার কালাবাড়ী এলাকার একমাত্র খেলার মাঠটিও। ২০১১ সালে উপজেলার দুই দশমিক ৭০ একর জায়গাকে খেলার মাঠ হিসেবে অনুমোদন দিলে ওই অঞ্চলের শিশু-কিশোরদের দিয়ে মুখর ছিল মাঠটি। কিন্তু মাঠটি দখল করে তৈরি করা হয়েছে ক্রাশার মিল, সংরক্ষণ করা হচ্ছে বালি ও পাথর।

পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে না জানিয়েই মাঠটি দখল করে নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। রাতের আঁধারেই শুরু হয় খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় খেলার মাঠকে দখল করে সেখানে তৈরি করা হচ্ছে মার্কেট ও পার্ক। ১৯৮৪ সালে সাত একরের ধূপখোলার এই মাঠটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করে তার এক ভাগ দেয়া হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে এবং বাকি দুটি অংশের একটি ইস্টএন্ড খেলার মাঠ নামক ক্লাব ও সর্বসাধারণের খেলার জন্য রাখা হয়। পুরো মাঠটির তিনটি অংশের প্রতিটির সীমানার প্রাচীর তুলে নেয়া হয়েছে, একই সঙ্গে তুলে নেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের দুই পাশে থাকা দুটি গোল পোস্ট। খোঁড়াখুঁড়ি করে মাটি ফেলা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় অংশের গেটে, যার ফলে মাঠটি ব্যবহার-অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

রাজধানীসহ সারাদেশের মাঠগুলোর করুণ অবস্থা এবং দখলের ফলে মাঠের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে একটা সময় পর দেখা যাবে খেলাধুলা ও শরীরচর্চার জন্য মাঠ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন খেলার মাঠ। দখল হয়ে যাওয়া মাঠগুলোকে পুনরুদ্ধার করা এখন সময়ের দাবি, আর যেসব মাঠ ব্যবহার-অনুপযোগী হয়ে আছে, তাদের ব্যবহার-উপযোগী করে তুলতে হবে এবং মাঠগুলোকে ব্যবহারযোগ্য করতে স্থানীয় প্রতিনিধি ও মেয়রদের দায়িত্ব নিতে হবে। শুধু তাই নয়, ক্ষমতার বলে দখল হয়ে যাওয়া মাঠগুলোকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। ব্যবহার-অযোগ্য মাঠগুলোকে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। খেলার মাঠগুলো যেন বখাটের আড্ডার স্থলে পরিণত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। মাঠগুলো সংস্কার করে সর্বসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করে দিতে হবে। শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য উপযুক্ত খেলার মাঠ তৈরি করতে হবে, যাতে তাদের প্রাণোচ্ছল শৈশব ঘরবন্দিভাবে না কাটে। সর্বসাধারণের প্রয়োজনে আরও নতুন নতুন মাঠ তৈরি করতে হবে।

শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০