‘দেশের পুঁজিবাজার অনেকটা গুজবনির্ভর বলা চলে’

মো. ছায়েদুর রহমান ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। একইসঙ্গে তিনি ইবিএল ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক, ইম্পেরিয়াল ক্যাপিটালের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছায়েদুর রহমান একজন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকও। দেশের বর্তমান পুঁজিবাজারের সার্বিক অবস্থা নিয়ে সম্প্রতি শেয়ার বিজের সঙ্গে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুজ্জামান সুমন

শেয়ার বিজ: উন্নত বিশ্বের পুঁজিবাজারের সঙ্গে আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের মূল পার্থক্য কী?

ছায়েদুর রহমান: উন্নত বিশ্বের পুঁজিবাজারের সঙ্গে আমাদের বাজারকে এভাবে মেলানো মুশকিল। উন্নত বিশ্বের মানুষের জীবনযাত্রা আর আমাদের জীবনযাত্রার মধ্যে পার্থক্যের বহিঃপ্রকাশ প্রত্যেকটা কাজে-কর্মে ফুটে ওঠে। তাদের সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, পরিবেশ-পরিস্থিতি, সমাজব্যবস্থা ও জীবনযাপনের প্রতিটি স্তরেই পার্থক্য বিরাজমান। পুঁজিবাজার, শিল্পায়ন, ব্যাংক, ফাইন্যান্স সবখানে ভিন্ন মত আছে। আমাদের দেশে যথেষ্ট নিয়মকানুন আছে এবং আমরা সেগুলো মেনেও চলি। তবে আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের সঙ্গে উন্নত দেশের পুঁজিবাজারের মূল পার্থক্য হচ্ছেÑআমাদের দেশের পুঁজিবাজার অনেকটা রিউমার অর্থাৎ গুজবনির্ভর বলা চলে। এখানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বিনিয়োগ করেন এবং বিনিয়োগকারীরা একজন অন্যজনকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। নিজে কোনো বিশ্লেষণ না করে কিংবা নিজের জ্ঞান প্রয়োগ না করে অন্যকে অনুসরণ করতে গিয়ে অনেকে বিপদে পড়েন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হন।

শেয়ার বিজ: মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো আশানুরূপভাবে বাজারে নতুন কোম্পানি আনতে পারছে না কেন?

ছায়েদুর রহমান: আপনি যেখানেই কাজ করেন, ঠিক সেখানেই আপনার স্বার্থ বিবেচনা করবেন, লাভের পরিমাণ হিসাব করবেন। একজন ইস্যুয়ার বা একজন উদ্যোক্তার ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই রকম। স্বভাবতই তারা হিসাব করে যে, পুঁজিবাজারে গেলে তাদের কী লাভ আছে? এক্ষেত্রে কোনোরকম উল্লেখযোগ্য লাভ কিংবা সুবিধার কথা আমরা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের বলতে পারি না। বরং আমরা বোঝানোর চেষ্টা করি যে, তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে অনেক আইনকানুনের মধ্য দিয়ে চলতে হয়। আইনি কাঠামোয় ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়ার বাধ্যবাধকতাসহ এরকম আরও অনেক বিষয় জড়িত; কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানিতে সেগুলোর প্রয়োজন হচ্ছে না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, একটি কোম্পানির তালিকাভুুক্তির সঙ্গে লভ্যাংশ দেয়ার যেমন বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তেমনি বাধ্যবাধকতা পরিপালনের জন্য আগের ট্যাক্সসমূহ পরিশোধ করে আসতে হয়। ওই কোম্পানি যদি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তাহলে সেটা তার কর-পূর্ববর্তী ব্যয় হিসেবে চার্জ হচ্ছে। একইসঙ্গে তাদের লভ্যাংশ দেয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকছে না। যারা ভালো ব্যবসা করছেন, তারা খুব সহজ ঋণ পেয়ে যাচ্ছেন। আবার ব্যাংকাররাও ভালো ব্যবসায়ীদের খোঁজ করছেন এবং সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছেন। সেই ঋণের খরচে সুদ বাবদ ব্যয়ও তুলনামূলকভাবে কোম্পানির ইক্যুইটির চেয়ে কম হয়। তাহলে সে কেন এই ইক্যুইটি বাড়াবে? তাই কোম্পানিগুলো ঋণ নিচ্ছে, ব্যবসাও চলমান আছে এবং ভালো করছে। ধারাবাহিকভাবে তারা নিজেদের ব্যবসায় ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে; আবার যখনই দেখছে ব্যবসা খারাপ হচ্ছে, তখনই ঋণ ফেরত দিয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত না হলেই তাদের সুবিধা বেশি, পক্ষান্তরে জবাবদিহিও অনেক কম। তালিকাভুক্ত হলে জবাবদিহি বেশি থাকে। সব ধরনের রেগুলেটরি ও মনিটরিংয়ের দায়িত্ব কোম্পানির ওপর বেড়ে যায়। ফলে আমাদের দেশে যারা সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী আছেন, তারা পুঁজিবাজারে আসতে উৎসাহিত হচ্ছেন না। তাদের জন্য উৎসাহজনক কোনো ব্যবস্থা আমাদের কাছে এখনও নেই।

শেয়ার বিজ: অনেক ইস্যুয়ার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোনো পাবলিক কোম্পানিকে আইপিওতে নিয়ে আসতে পারছেন নাÑএর কারণ কী?

ছায়েদুর রহমান: বিষয়টিকে এভাবে দেখলে হবে না। যারা ইস্যুয়ারের ভূমিকায় আছেন, তারা চেষ্টা করছেন। আমাদের দেখা দরকার, পাবলিক কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহী কি না, বিদেশি কোনো উদ্যোক্তা আমাদের দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী কি না। যারা ব্যবসায় ভালো করছে, তাদের তো এমনিতেই অর্থসংকট কম, অবস্থানগতভাবে তারা নিজেদের জায়গায় বেশ নিশ্চিন্ত। শুধু ব্যাংক, বিমা, লিজিং কোম্পানি কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকাভুক্তির জন্য আইনি বাধ্যবাধকতায় রয়েছে; অন্য খাতে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। মাত্র আটটি বহুজাতিক কোম্পানি আমাদের দেশে তালিকাভুক্ত হয়েছে।

শেয়ার বিজ: কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ার দুএক বছরের মধ্যে নতুন কোম্পানিগুলোকে ন্যূনতম ডিভিডেন্ড বানোডিভিডেন্ড দেয়ার প্রবণতায় ভুগতে দেখা যায়, এটি কি বাজারে আসা নতুন কোম্পানির সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে না? নাকি ইস্যু ম্যানেজার পাবলিক কোম্পানিগুলোর যোগসাজশের ফল হিসেবে বাজারে ধরনেরতুলনামূলক দুর্বল পাবলিক কোম্পানির আগমন?

ছায়েদুর রহমান: পাবলিক কোম্পানি ঘোষণা দিয়েই বাজারে আসে। তালিকাভুক্তির পরে সে ব্যবসা খারাপ করবে কি না, কিংবা তার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে কি না, সেটা কিন্তু কোম্পানিটির বাজারে আসার পর তাদের কার্যক্রম দেখে মূল্যায়িত হয়। এক্ষেত্রে নিজেদের ভূমিকায় ইস্যু ম্যানেজারগুলো কোম্পানিটির সার্বিক অবস্থা তথা অডিট রিপোর্ট ও অন্যান্য নথি যাচাই করে সে অনুযায়ী প্রস্তাবনা পেশ করে। অর্থাৎ ভবিষ্যতের ব্যবসা সম্পর্কে ইস্যু ম্যানেজাররা কখনোই কোন ধরনের পূর্বাভাস দিতে পারেন না। বরং পাবলিক কোম্পানি তথা উদ্যোক্তারা যেমন আগ্রহ প্রকাশ করে, তেমনটাই ইস্যু ম্যানেজাররা ইনকরপারেট করে।

শেয়ার বিজ: গত এক বছরে ১০ টাকার শেয়ার ২০০ টাকা হয়েছে, ২৫০ টাকার শেয়ার ৯৫০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে, কিন্তু স্কয়ার ফার্মার মতো ব্লু চিপ কোম্পানির শেয়ার তেমন বাড়ে না কেন?

ছায়েদুর রহমান: দেখুন একজন বিনিয়োগকারী কোন শেয়ার কিনবেন বা বিক্রি করবেন, এটা আমরা তাকে বলতে পারি না। প্রথমেই বলেছি, আমাদের সঙ্গে অন্য দেশের পুঁজিবাজারের মূল পার্থক্য হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের গুজবনির্ভরশীলতা। ধরুন একটা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, অথবা নন-পারফর্মিং ছিল। এখন প্রতিষ্ঠানটি আবার ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করছে। এতে ভবিষ্যতে ওই কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের অধিক হারে লভ্যাংশ দেবে, তেমন প্রত্যাশা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কিন্তু দেখা যায়, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ওই ধরনের প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে বড় উদাহরণ আমাদের ব্যাংকিং খাতের কোম্পানি। ব্যাংকের শেয়ারের দাম কিন্তু তেমন বাড়েনি। মার্জিনে এরা যে পরিমাণ ঋণ দেয়, তার ডিভিডেন্ডের পরিমাণ এফডিআর রেটের চেয়েও বেশি। অথচ তারপরও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ওইসব ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন না! উল্টো তথাকথিত ফটকা শেয়ারে তারা বিনিয়োগ করছেন! আর তারা যদি এ ধরনের শেয়ারে বিনিয়োগ করেন, তাহলে একজন ব্রোকার হিসেবে কী করতে পারি?

আপনি যদি আমার কাছে পাঁচটি কোম্পানির শেয়ার অর্থাৎ পারফরম্যান্স সম্পর্কে ধারণা নিতে চান, সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে থাকা বিভিন্ন তত্ত্ব-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আপনাকে জানাতে পারি, কিন্তু আপনাকে বলতে পারি না যে, ‘এই শেয়ার কিনেন’ বা ‘ওই শেয়ার বিক্রি করেন।’ কারণ লাভ-লোকসানের দায় কোম্পানির নিজের। সহজ কথা, আপনি যদি একজন পরামর্শক বা ব্রোকার কিংবা মার্চেন্ট ব্যাংকের কাছে যান, তিনি হয়তো আপনাকে পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার একচ্ছত্র মালিক আপনি নিজেই।

অথচ আমাদের বাজারে বিনিয়োগকারীরা কোম্পানি সম্পর্কে ন্যূনতম কোনো ধারণা কিংবা বিশ্লেষণ না করে গুজবের ওপর দৌড়াচ্ছেন।

আর একটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা ক্যাপিটাল গেইনের প্রতি বেশি আগ্রহী। তারা লভ্যাংশের দিকে যেতে চান না। কারণ ডিভিডেন্ড নিলে কর দেয়া লাগে। যারা হাই নেটওয়ার্কের ইন্ডিভিজুয়াল আছেন, তারা সর্বোচ্চ হারে কর দেন। পক্ষান্তরে সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কিন্তু ডিভিডেন্ড ইনকামের ওপর উচ্চহারের কর দিতে হয় না, আবার ক্যাপিটাল গেইনের ক্ষেত্রেও কর দিতে হয় না। তাদের ডিভিডেন্ডের প্রতি আকর্ষণ নেই। তারা তখন ক্যাপিটাল গেইন করার জন্য ফটকা শেয়ারের পেছনে দৌড়ান। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এখানে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। বাজার উত্থান-পতনের নেপথ্যে কিন্তু স্কয়ার ফার্মার মতো গ্রুপ অব কোম্পানির শেয়ারে তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। এটা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আচরণের ওপর নির্ভরশীল। এখন কেউ যদি স্পেকুলেশনের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করে, তাহলে স্পেকুলেটিভ মার্কেট মুভমেন্ট করবে বেশি এটাই স্বাভাবিক। তার মানে বিনিয়োগকারীদের আচরণই এখানে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, সে ইনস্টিটিউট বা ইন্ডিভিজুয়াল তথা বড় বা ছোট যেমন বিনিয়োগকারী হোন না কেন। তবে আমাদের কাছে বড় ইস্যু হলো বিনিয়োগকারীর প্রত্যাশা কী? আবার বিনিয়োগকারী তো এখানে লাভের জন্যই আসছেন, তাই যেখানে তার বেশি লাভ হবে সে তো সেখানেই যাবে। অবাস্তব লাভের প্রত্যাশায় যখন বিনিয়োগকারীরা আসক্ত হন, তখনই ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি হয়। সর্বোপরি এ জায়গায় আমাদের দুর্বলতা বা দূরদর্শিতার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।

শেয়ার বিজ: ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্যানিক সেলএর দরুণ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পোর্টফলিওতে সৃষ্ট তারল্য সংকট কতখানি?

ছায়েদুর রহমান: এখানে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত, আমাদের পুঁজিবাজারে গুজবের ভিত্তিতে বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা করার প্রবণতা বেশি। যেমন সম্প্রতি ইউক্রেনের যুদ্ধ ইস্যুতে মার্কেটের সূচকের পতন ঘটেছে। ইউক্রেনের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক কতটা গভীর, কিংবা এই যুদ্ধের দরুণ আমাদের দেশের কত শতাংশ বিনিয়োগ প্রভাবিত হতে পারে বিষয়টা আমাদের বিনিয়োগকারীরা কতখানি জানেন, না জেনেই যদি তারা প্যানিক সেল করে ফেলেন, তবে সেটা তো কোনো ‘রেশনাল বিহ্যাভিয়ার’ হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলার দিয়েছে ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনগুলোর জন্য। তাদের রিপোর্টিং অনুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ইনভেস্টমেন্টে তাদের ক্যাপাসিটি কমিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, ইনভেস্টমেন্টের ক্যাপাসিটি কমিয়ে দিলে কতটুকু কমছে? এখন সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বাজারে যদি ১০০ কোটি বা ২০০ কোটি অথবা ৫০০ কোটি টাকার ক্যাপাসিটি কমে, তাতে কী আসে-যায়? অথচ এমন বিষয় নিয়েও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত।

তৃতীয়ত, নেগেটিভ ইক্যুইটি নিয়ে কিছুদিন আগে একটি সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল। পরে তা নিয়ে অনেক মাতামাতি হয়েছে। অথচ ওই মিডিয়া প্রতিষ্ঠানসহ কেউই সঠিক তথ্য জানেন না! সঠিক তথ্য হলোÑনেগেটিভ ইক্যুয়িটির সমন্বয়ে আগামী ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। তার মানে ২০২৩ সালের পর বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে, ২০২২-এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কেন বিষয়টিতে আলোচনা হচ্ছে? এখনও সময় আছে, এটা নিয়ে আলোচনা করাই উচিত ছিল না। আপনার ধারণা হয়েছে সাত-আট হাজার কোটি টাকার নেগেটিভ ইক্যুয়িটি শেয়ার বিক্রি করে দেয়া হবে! এই সাত-আট হাজার কোটি টাকার নেগেটিভ ইক্যুইটি শেয়ারবাজারে বিক্রি হয়ে যাবে কত টাকা রিকভারির জন্য? আর শেয়ার বিক্রির প্রসঙ্গটাই বা কেন আমাদের মাথায় ঢুকেছে? আমাদের নেগেটিভ ইক্যুইটি আছে, এটা আমি কীভাবে সমন্বয় করব, সেটা তো আমার অভ্যন্তরীণ পলিসির বিষয়। এটি সমন্বয় করতে শেয়ার বিক্রি করে দিতে হবে, এমন কথা তো কমিশন বলেনি। কমিশন সময় দিয়েছে, ২০২৩ সালের মধ্যে নেগেটিভ ইক্যুইটি সমন্বয় করতে হবে। এরপর আমি যদি সমন্বয় করতে না পারি, তখন রেগুলেটরের শরণাপন্ন হবো এই মর্মে যে, ‘আমাকে সময় দিন।’ কিন্তু আমি আতঙ্কজনক পরিস্থিতি কেন তৈরি করব? এটি নিয়ে তো আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

শেয়ার বিজ: দরপতন ঠেকাতে সার্কিট ব্রেকার পদ্ধতির নতুন নীতি (দরবৃদ্ধিতে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ দরপতনে সর্বোচ্চ দুই শতাংশ) বিনিয়োগকারীদের কতখানি অনুকূলে বলে আপনি মনে করেন?

ছায়েদুর রহমান: হঠাৎ করে ক্রাইসিস সামনে এলে আপনি প্রাথমিকভাবে তা সামলানোর চেষ্টা করেন। মূলত প্যানিক সেলের প্রেসারে বেশিরভাগ দরপতন হলে সে খাতে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। অবশ্য এর একটি ভালো দিকও রয়েছে। আজকে (সাক্ষাৎকার গ্রহণের দিন) দেখুন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। এই মুহূর্তে আমাদের বাজারের সূচক ১২২ পয়েন্ট পজিটিভ আছে। তার মানে যে বিনিয়োগকারীরা গতকাল শেয়ার বিক্রি করেছেন, তারাই আজ শেয়ার কিনেছেন। পরশু হয়তো কম দামে বিক্রি করছেন, আজ হয়তো বেশি দামে কিনছেন। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীরা এত বেশি সেনসিটিভ যে কোনো কিছুতেই খুব দ্রুত রিঅ্যাক্ট করে। এই রিঅ্যাকশনের ফলে তাদের নিজেদেরও কিন্তু ক্ষতি হয়। আর বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হওয়া মানে বাজারের ক্ষতি হওয়া। আমরা প্রত্যাশা করি, পরামর্শ দিই ও অনুরোধ করি যেন বিনিয়োগকারীরা জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করেন। সাধারণত ১০০ টাকা ব্যাংকে রাখলে বছরে বিনিয়োগকারীরা পাঁচ থেকে ছয় টাকার বেশি লাভ পাবেন না, সেখানে পুঁজিবাজার থেকে তারা কত লাভ চান? প্রত্যাশানুযায়ী বিনিয়োগকারীদের উচিত একটা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেয়া। তাহলে দেখা যাবে তাদের আর ক্ষতি হচ্ছে না। অথচ দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের এই কথাটা অনেকেই শুনতে চান না, বুঝতে চান না।

শেয়ার বিজ: বিএসইসি নতুন নির্দেশনায় স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের ১০০ কোটি টাকা আইসিবিকে বিনিয়োগ করতে দেয়ায় বাজার সক্ষমতা কতটুকু বৃদ্ধি পাবে বিনিয়োকারীদের কতখানি সুবিধা হবে?

ছায়েদুর রহমান: এতে নির্দিষ্টভাবেই বাজারের সক্ষমতা বাড়বে। শুধু সিএমএসএফ নয়, ৩১টি তফসিলি ব্যাংকের জন্য ২০০ কোটি টাকা করে বিনিয়োগের নির্দেশনা রয়েছে। এতে ৬ হাজার ৩০০ কোটি নগদ অর্থ যদি বাজারে প্রবেশ করে, তাহলে বাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। মূলকথা বাজারে যত ফান্ডের সাপ্লাই বাড়বে, লিকুইডিটি বাড়বে, ততই বাজার ইতিবাচক ধারায় থাকবে। সাধারণত এ বিষয়ে অর্থের মাপকাঠিতে বিবেচনা করা হয়, অর্থের জোগান যত বেশি থাকবে চাহিদাও বেশি থাকবে। ফলে বাজার ইতিবাচক থাকবে।

শেয়ার বিজ: আদতে নতুন পদ্ধতির ট্রেডিং সাইকেল স্যাটেলমেন্ট +এর সুবিধা আছে কি?

ছায়েদুর রহমান: এর সুবিধা ও অসুবিধা দুই-ই আছে বলতে হয়। সুবিধা বলতে যেমন স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেনের পরিমাণ বাড়লে স্টক এক্সচেঞ্জ ব্রোকার ইনকাম বাড়বে, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি বাড়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। সম্ভাবনা বলছি কারণ এখন তো বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী গুজবের পেছনে ঘোরেন। তো সেই জায়গাটাতে যখন ঞ+১ ট্রেডিবল হবে, তখন আরও ফটকাবাজির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর সেটি যত বেশি হবে, তত বেশি ঝুঁকি বাড়বে।

শেয়ার বিজ: বিনিয়োগ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শিক্ষায় প্র্যাকটিক্যালি কোনো শিক্ষার্থীর পক্ষে বাস্তব জ্ঞান আহরণ করার যথেষ্ট সুযোগ আমাদের দেশে রয়েছে কি না?

ছায়েদুর রহমান: আমাদের ২০১৭ সাল থেকে বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে, এখনও চলমান এবং চলবে। কিন্তু এখানে আমরা খুব সফল হয়েছি, তেমনটি নয়। তবে তুলনামূলকভাবে আগের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে যাচ্ছি। এর আগে আমাদের রেগুলেটরের পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু একটা শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন বেশ দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে, একইসঙ্গে সেখানে সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ও জড়িত। সাধারণত সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে হয় না, একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়। আগামী দিনে এগুলো হবে বলে প্রত্যাশা করি, কারণ আমরা সার্বিক উন্নয়নের কথা যখন চিন্তা করব, তখন আমাদের কর্মমুখী শিক্ষার দিকে অনেক মনোযোগী হতে হবে।

শেয়ার বিজ: বিনিয়োগ শিক্ষা অর্জনের ফলে কর্মক্ষেত্রে কাজের সুযোগ বা মূল্যায়ন কতখানি বলে আপনি মনে করেন?

ছায়েদুর রহমান: আপনি যদি রিক্রুটমেন্টের কথা বলেন তাহলে বলব, বিআইসিএমের সার্টিফিকেট থাকলে বা বিএএসএমের সার্টিফিকেট থাকলে, সেটাকে আমরা অবশ্যই প্রাধান্য দেব। সাধারণত বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলেমেয়েদের ক্যাপিটাল মার্কেটে কাজ করার জন্য নিচ্ছি। তারা যখন আরও অতিরিক্ত ডিগ্রি, যেমন বিআইসিএম ডিপ্লোমা করবে, বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করবে, অথবা বিএএসএমের ডিগ্রি অর্জন করবেÑতাকে আমরা অগ্রাধিকার দেব, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০