জোহরা শিউলী: সমাজে বাড়ছে কিশোরগ্যাং অপরাধ। একটা সময় ছিল যখন রাস্তাঘাটে কিশোর মানেই লাজুক লাজুক ছেলেরা। সেটার জায়গা দখল করেছে এখন উদ্ভট চুলের কাটে কিশোররা। অভিভাবকসহ সমাজ এখন ভাবছে, কিশোরদের এমন অবস্থার কারণ কী?
ঘরে বন্দি থেকে বড় হওয়া, খেলার মাঠ না পাওয়ার কারণ তো আছেই। এ ছাড়া মাদকাসক্ত হওয়া এর একটা বড় কারণ বলেও ধরা হয়, যার দরুন কিশোর-কিশোরীরা বিপথে পা বাড়াচ্ছে নিজেদের অজান্তে।
কিশোর-কিশোরীদের মাদকাসক্তি বলতে আমরা কী বুঝি? মাদকাসক্তি বলতে বোঝায় মাদকদ্রব্যের প্রতি নেশাকে। যেসব দ্রব্য সেবন করলে আসক্তির সৃষ্টি হয়, জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা ও স্মৃতিশক্তি কমে যায়, সেগুলো বাংলাদেশে অভিহিত করা হয়েছে মাদকদ্রব্য হিসেবে। সিগারেট, বিড়ি, তামাক, মদ, তাড়ি, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, চরস, ভাং, মারিজুয়ানা, মরফিন, ইয়াবা ইত্যাদি হলো মাদকদ্রব্য।
মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের এক বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭৫ লাখের বেশি। এসব মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই কিশোর ও তরুণ। ২০২১ সালে এসেও কিশোর ও তরুণ মাদকসেবীদের এই পরিসংখ্যান অপরিবর্তিত রয়েছে। জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ২৫ লাখ শিশু-কিশোর তথা অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সী মাদকসেবী রয়েছে।
ড. অরুপ রতন কিছু বিশ্লেষণধর্মী কারণ তুলে ধরে বলেন, “শিশু-কিশোরদের মাদকসেবনের পেছনে নানা ধরনের কারণ থাকতে পারে। প্রথমবার শিশু-কিশোররা মাদকের সঙ্গে পরিচিত হয় সাধারণত কোনো সোশ্যাল সেটিংসে, যেখানে মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা রয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ শিশু-কিশোরের মাদকসেবনে হাতেখড়ি ঘটে সাধারণত স্কুলে কিংবা পাড়া-মহল্লায় সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবের দিয়ে প্ররোচিত হয়ে। শিশু-কিশোরদের নিয়মিত ধূমপান বা অন্যান্য মাদকসেবন হতে পারে মূলত অনিরাপত্তাবোধ থেকে কিংবা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভের আকাক্সক্ষার ফলে। অনেকে মাদকসেবনকে ‘বয়সের দোষ’ হিসেবেও অভিহিত করে থাকে। এই বয়সে শিশু-কিশোররা অনেক বেশি বেপরোয়া হয় এবং যেকোনো কাজে তারা পরিণামের কথা চিন্তা না করেই অংশগ্রহণ করে ফেলে।”
কম বয়সে মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের পরবর্তী জীবনে মাদকের প্রতি পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মাদকাসক্ত হওয়ার সঙ্গে বিচারবুদ্ধি লোপ পাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। কোনো শিশু বা কিশোরের যদি আগে থেকেই বিভিন্ন মানসিক অবস্থা যেমন ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি প্রভৃতি থাকে, মাদকাসক্তির ফলে সেগুলো আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। অ্যালকোহল কিংবা অন্য কোনো মাদকসেবনের পর অনেক শিশু-কিশোরই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যেমন অনেকেই চায় নিজেদের গাড়ি বা মোটরসাইকেল চালানোর দক্ষতা অন্যদের দেখাতে। এতে করে রাস্তায় তাদের নিজেদের তো বটেই, পথচারীদেরও দুর্ঘটনায় প্রাণনাশের কারণ হতে পারে। মাদকাসক্তির ফলে স্বভাবতই শিশু-কিশোরদের পড়াশোনায় মন বসে না, স্মৃতিশক্তিও লোপ পায়। ফলে তাদের একাডেমিক পারফরম্যান্স নি¤œগামী হতে থাকে। মাদকসেবন একপর্যায়ে মাদকাসক্তিতে পরিণত হয়। পরে তা মানুষকে বিভিন্ন শারীরিক অক্ষমতা ও দুর্বলতা, অসুস্থতা, এমনকি মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দেয়।
কিশোর-কিশোরীদের মাদকাসক্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি সহায়তা করতে পারে মা-বাবা। অভিভাবকের উদাসীনতার ফলেই তারা শিশু-মাদকাসক্তের শিকার হয়। সন্তান মারমুখী ও আগ্রাসী আচরণ করলে শারীরিক অবয়বের পরিবর্তন বা আকস্মিক স্বাস্থ্যহানি ঘটলে, হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেলে বা নিজেকে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকে গুটিয়ে নিলে, খাওয়া ও ঘুমের প্যাটার্ন পরিবর্তিত হলে কিংবা বারবার অদায়িত্বশীল আচরণ করলে, দুর্বল বিচারবুদ্ধি এবং সামগ্রিকভাবে আগ্রহের অভাব দেখা দিলে বোঝা যায়, সে খারাপসঙ্গ বা মাদকাসক্তির শিকার। এক্ষেত্রে শিশু-কিশোররা বারবার পারিবারিক বিধিনিষেধ অমান্য করে। এমনকি কোনো ধরনের অসুস্থতা না থাকা সত্ত্বেও তার ঘরে ওষুধের শিশি বা পাতা দেখা যায়।
দেশে মাদকের ভয়াবহতা ও ব্যাপ্তি ঠেকাতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন রয়েছে। আইনটিতে মাদকের পরিমাণ অনুযায়ী শাস্তিও নির্ধারণ করা হয়েছে। আইনে কমপক্ষে দুই বছর থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। তবে মাদকদ্রব্যের পরিমাণ যদি ১০ গ্রামের ঊর্ধ্বে হয়, সেক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ইয়াবা, সিসা, কোকেন, হেরোইন ও পেথিডিন জাতীয় মাদকের ব্যবহার, সেবন, বহন, আমদানি-রপ্তানি বা বাজারজাত করার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ৫ গ্রাম পর্যন্ত কোকেন, হেরোইন, মরফিন ও পেথিডিন পাওয়া গেলে ১ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়া যাবে। এই মাদকের পরিমাণ ৫ থেকে ২৫ গ্রামের মধ্যে হলে ৫ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড এবং মাদকের পরিমাণ ২৫ গ্রাম বা তার বেশি হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড ও অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। মাদক নির্মূলে রয়েছে এমন শক্তিশালী আইন। অপিয়াম, ক্যানাবিস রেসিন বা (অপিয়াম উদ্ভূত, তবে হেরোইন ও মরফিন ব্যতীত মাদকদ্রব্য) এসব মাদকদ্রব্যের পরিমাণ অনূর্ধ্ব ২ কেজি হইলে কমপক্ষে ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ডেরও বিধান রাখা হয়েছে। আর এর পরিমাণ ২ কেজির ঊর্ধ্বে হলে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে গেলে মা-বাবাকে ধৈর্যহারা হওয়া উচিত নয়। মা-বাবা সন্তানের সবচেয়ে আপনজন। সন্তানের ব্যথা পিতা-মাতাকে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত করে। বিপথগামী সন্তানকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরেয়ে আনতে মা-বাবার বন্ধুসুলভ আচরণ প্রয়োজন। সন্তানের সঙ্গে হƒদয়ের উষ্ণতা দিয়ে কথা বলতে হবে। শিশু-কিশোরদের সচেতন করতে বা তাদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ উপায় হলো সোজাসুজি, খোলামেলা তাদের সঙ্গে যেকোনো বিষয়ে কথা বলা। শিশু বা কিশোর বয়সী সন্তান মাদকসেবী না হলেও ভবিষ্যতের চিন্তা করে তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে। তাকে সিগারেট, অ্যালকোহল ও অন্যান্য নেশাদ্রব্যের ক্ষতিকর দিক ও এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বুঝিয়ে বলতে হবে। কেন এগুলো সেবন করা উচিত নয়, তা বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে, উদাহরণ দিয়ে দরদের সঙ্গে বোঝাতে হবে। পাশাপাশি সন্তান কার সঙ্গে মেশে, কোথায় যায়, কী করেÑএ ব্যাপারে সবসময় খবরাখবর নিতে হবে। ছেলে-মেয়ের বন্ধুবান্ধবদের ভালো করে চিনতে হবে। তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে, তারা সন্তানের জন্য অসৎ সঙ্গ নয়। এছাড়া পারিবারিক মূল্যবোধের চর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, যা সন্তানের ভেতরও প্রভাবিত হবে। সুশৃঙ্খল জীবনাচারে অভ্যস্ত করতে হবে।
পরিবারের জন্য বাধ্যতামূলক পালনীয় কিছু নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ তৈরি করতে হবে এবং সন্তানদের সেসব বিধিনিষেধের নেপথ্যে যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। সন্তান যেন ঠিকমতো বিধিনিষেধ মেনে চলতে পারে, সেদিকে সবসময় সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। কোনো কারণে সন্তান মাদকাসক্ত, বিষয়টি প্রমাণ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথা গরম করে তাকে বকাবকি করা যাবে না। তার কোনো কাজে তাৎক্ষণিক বাধা দেয়া ঠিক হবে না। বরং ঠাণ্ডা মাথায় তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। ধৈর্য ও সহানুভূতির সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করে শিশুর মানসিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখাই হবে মা-বাবা এবং পরিবারের অন্য সদস্যের দায়িত্ব। যদি নিজে নিজে বুঝিয়ে-শুনিয়ে, খবরাখবর নিয়েও সন্তানকে মাদকের পথ থেকে ফিরিয়ে না আনা যায়, তাহলে অবশ্যই পেশাদার কারও সাহায্য নিতে হবে। সেটি হতে পারে কোনো চিকিৎসক, কাউন্সেলর বা স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞ। তাদের পরামর্শ মতো কাজ করলে সন্তানের ভুল পথে পা বাড়ানো রোধ করা সম্ভব।
পরিশেষে বলা যায়, শিশু-কিশোরদের ভালো বন্ধু হয়ে উঠলে, তার মনের খবর রাখলে, যেকোনো সময় তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে সন্তান বিপথে যাবে না। মা-বাবার মানসিক সহায়তা পেলে এবং ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক জীবন নিয়ে সন্তানের মধ্যে কোনো অনিরাপত্তা বা অনিশ্চয়তাবোধ না থাকলে, তার মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেকাংশেই কমে যায়। মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমের ভূমিকাও এ সঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যম যদি আরও অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচিতে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে, তবে মাদক নিয়ন্ত্রণের চলমান লড়াইটা আরও সহজ হয়ে যাবে।
পিআইডি নিবন্ধ