বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: তিন বছরেও সংস্কার করা হয়নি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) পরিত্যক্ত ভবন। ফলে চলমান কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের ইউনিট অফিস স্থাপন কার্যক্রম আর আলোর মুখ দেখেনি। এতে উপজেলার হাজার হাজার কৃষক আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিসেবা থেকে বঞ্চিত হলেও সংশ্লিষ্টরা রয়েছেন নির্বিকার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কচুয়া পৌর এলাকার কুরেশ মৌজায় বিএডিসি সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের তত্ত্বাবধানে ২০ দশমিক ছয় শতাংশ জায়গায় ২০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি সার গুদামসহ কয়েকটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। এসব স্থাপনা কত সালে তৈরি হয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রায় দুই দুগেরও বেশি সময় ধরে সেখানে বিএডিসি সার উইংয়ের সব কার্যক্রম চলমান। একসময় রহস্যজনকভাবে সার গুদাম ও ভবনগুলোয় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করার বিভিন্ন গোপন প্রক্রিয়াও চলমান থাকে। এরপর প্রভাবশালীরা সার গুদামের সামনে থাকা খাল ভরাট করে লিজের নামে রাতারাতি দোকানপাট নির্মাণ করে। তখন থেকেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। লিজের নামে বেদখল হয়ে যায় বিএডিসি ভবনে প্রবেশের রাস্তাটি। এভাবে কেটে যায় প্রায় এক যুগ।
কচুয়া পৌর ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বিএডিসি কুমিল্লা যুগ্ম পরিচালক (সার) উইং থেকে ১৯৮২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কুরেশ মৌজায় ৫২৯ দাগের ২০ শতাংশ ছয় পয়েন্ট ভূমির উন্নয়ন কর পরিশোধ করা হয়েছে। বিএডিসি ২৮ বছর পর্যন্ত ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করলেও ২০১০ সালের পর থেকে আর ভূমি উন্নয়ন কর দিচ্ছে না বিএডিসি। ২০১৮ সাল থেকে ৯৯নং কুরেশ মৌজার বিএডিসির এ সম্পত্তি কাকতালীয়ভাবে ১নং খতিয়ানে সরকারের নামে বিএস ভলিউমে চূড়ান্তভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।
এদিকে ২০১৯ সালে বিএডিসির আওতায় তিনটি জেলার ৩৪টি উপজেলা নিয়ে ‘কুমিল্লা-চাঁদপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সেচ এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে ৩২৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে কচুয়া বিএডিসি (ক্ষুদ্রসেচ) ইউনিটের জন্য ইউনিট অফিস নির্মাণ করার কথা থাকলেও প্রভাবশালী একটি চক্র লিজের নামে প্রবেশপথে দোকানপাট নির্মাণ করে হাতিয়ে নেয় প্রায় কোটি টাকা। এতে সার গুদামে প্রবেশের রাস্তা বেদখল হয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি বিএডিসি সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের সংরক্ষণ শাখা থেকে কচুয়া পৌর এলাকার (সার গুদামের পাশেই বাড়ি) মো. তরিকুল ইসলাম বরাবর নোটিস পাঠানো হয়। নোটিসে উল্লেখ করা হয়, ‘সার ব্যবস্থাপনা উইংয়ের আওতাধীন কুমিল্লা অঞ্চলের চাঁদপুর জেলায় কচুয়া উপজেলাস্থ বিএডিসির ২০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন সার গুদাম ও অন্যান্য স্থাপনা ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আপনার নিকট দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী ভাড়া প্রক্রিয়াধীন। সংস্থার প্রয়োজনে আপনার সঙ্গে কোনো দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করা হয়নি। বর্তমানে কচুয়া উপজেলাস্থ গুদামটি আপনার নিকট ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভোগদখল থাকা বাবদ পাঁচ হাজার ৭৯০ টাকা পাওনা রয়েছে।’
উল্লেখ্য, ওই গুদামের স্থানে কুমিল্লা-চাঁদপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সেচ এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পে ইউনিট অফিস কাম ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। দখলে থাকা বাবদ বকেয়া ভাড়াসহ অন্যান্য পাওনা পরিশোধ করে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে গুদামটি হস্তান্তর করার জন্য নোটিস দেয়া হয় তরিকুল ইসলামকে। তরিকুল ইসলাম আজ পর্যন্ত বিএডিসির গুদামটি হস্তান্তরসহ পাওনা টাকা পরিশোধ করেছেন কি না, সংশ্লিষ্টরা সে ব্যাপারে মন্তব্য করতে অনীহা প্রকাশ করেন। সার গুদামে তরিকুল ইসলাম এখন ছাগলের ঘর বানিয়ে উন্নত জাতের ছাগল লালনপালন করছেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রায় তিন যুগ যাবৎ বিভিন্ন কৌশলে কচুয়া উপজেলার বিএডিসির এ ভবন দখল করার জন্য একটি প্রভাবশালী চক্র বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছে। লিজের নামে বিএডিসি ভবনে প্রবেশের রাস্তার জায়গাসহ পার্শ্ববর্তী খাল দখল করে দোকানপাট নির্মাণ করে পজেশন বিক্রির নামে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করেছে তারা।
অপরদিকে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিএডিসির পরিত্যক্ত সার গুদামে প্রবেশের রাস্তা দখল করে দোকানপাট নির্মাণ করায় সেচ এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পের ইউনিট অফিস নির্মাণে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, যার কারণে প্রকল্প চালু হওয়ার তিন বছর পরও নির্মিত হয়নি প্রকল্পের ইউনিট অফিস।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের মার্চ মাসে বিএডিসি চাঁদপুর জোনের সহকারী প্রকৌশলীর (ক্ষুদ্রসেচ) দপ্তর থেকে চাঁদপুর জেলা পরিষদ প্রধান নির্বাহী বরাবর বরাদ্দকৃত দুটি দোকান উচ্ছেদ করার নোটিস দেয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জেলা পরিষদের নির্দেশে একটি দোকান উচ্ছেদ করে বিএডিসির পরিত্যক্ত সার গুদামে প্রবেশের রাস্তা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। রাস্তা উন্মুক্ত করে দেয়ার এক বছর অতিবাহিত হলেও এখনও পরিত্যক্ত ভবন সংস্কারের কোনো উদ্যোগ না নিয়েই নির্বিকার রয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিএডিসির চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে বিএডিসির বিদ্যমান সার গুদামসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ, পুনর্বাসন এবং নতুন গুদাম নির্মাণের মাধ্যমে সার ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জোরদারকরণ প্রকল্প (২য় পর্যায়) প্রকল্পটি চলমান রয়েছে। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরাও পরিত্যক্ত সার গুদামটি সংস্কার করতে এখনও কোনো উদ্যোগ নেননি।
সূত্র জানায়, গত বছর পরিত্যক্ত ভবন নিয়ে শেয়ার বিজে সংবাদ প্রকাশের পর টনক নড়ে সংশ্লিষ্টদের। একজন কর্মকর্তাকে কচুয়া ভূমি অফিসে পাঠিয়ে খোঁজখবর নেন বিএডিসি কুমিল্লা জোনের সংশ্লিষ্টরা। পরে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করার প্রক্রিয়া চালায় বিএডিসি। তবে বিএডিসির খরিদকৃত সম্পত্তি কীভাবে সরকারের নামে ১নং খতিয়ানে লিপিবদ্ধ হয়েছে, সে রহস্য জানা যায়নি।
এ বিষয়ে কুমিল্লা-চাঁদপুর-বাহ্মণবাড়িয়া জেলা সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের পিডি মিজানুর রহমানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। পরে প্রকল্পে কর্মরত বিএডিসি শ্রমিক কর্মচারী লীগের সমাজ কল্যাণ সম্পাদক রেজাউল করিমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, প্রকল্পের ইউনিট অফিস কাম ট্রেনিং সেন্টার সম্পর্কে পিডি জানেন, সবকিছু আমি বলতে পারব না।