মো. রেজুয়ান খান: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুধু পাবনাবাসীকেই আতঙ্কিত করেনি, পুরো পাকিস্তানি আগ্রাসী সেনাদেরও করেছিল হতবিহ্বল। ইয়াহিয়ার সেনাদের ধারণাই ছিল না, নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালি প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ হলে কতটা দুঃসাহসী হতে পারে। অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় ছিল চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলা। ২৭ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পাবনার সাধারণ মানুষ আর নেতাকর্মীদের প্রতিরোধ আক্রমণে অর্ধশতাধিক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছিল।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যদল পাবনা শহর থেকে চার মাইল দূরে হিমায়েতপুরে ঘাঁটি গাড়ে। সেখান থেকে পাক সেনারা পাবনা শহরের ট্রেজারি অফিস ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিস দখল করে। তারা পাবনা শহর ঘিরে ফেলে। শহরময় মাইকে কার্ফু জারির ঘোষণা প্রচার করা এবং সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়া হচ্ছিল। বাইরে কেউ বেরুলে গুলি করা হবে বলে প্রচার চালানো হচ্ছিল। সেদিনই পাবনা শহরের তৎকালীন এমএলএ আমিন উদ্দিন, ভাসানী ন্যাপের জেলা সভাপতি ডা. অমলেন্দু দাক্ষী, তৃপ্তি নিলয় হোটেলের মালিক সাঈদ তালুকদারসহ ৫০ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে ওই নেতাদের তারা গুলি করে হত্যা করেছিল। ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ দেশব্যাপী স্বাধীনতাকামী মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল। ৭ মার্চের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলাদেশের প্রত্যেক পাড়ায় ও মহল্লায় দুর্গ গড়ে তোলার জন্য আপামর জনতা সেদিন এক হয়েছিল। পাকিস্তানি আগ্রাসন প্রতিরোধে পাবনার তৎকালীন ডিসি নূরুল কাদের খান, পাবনার এসপি আবদুল গাফফার, স্থানীয় নেতাকর্মীসহ বিশাল মুক্তিকামী মানুষ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা বাঙালিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালাতে পারে, সে আশঙ্কা অনেকের মনে সেই সময়ে উদিত হয়েছিল। পাবনার ডিসি ও এসপি মনস্থির করেছিলেন, পাবনা শহর শত্রু সেনাদের দ্বারা আক্রান্ত হলে জীবনের বিনিময়ে হলেও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন তারা। সেদিন শতাধিক পুলিশ সদস্যও পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে মনেপ্রাণে প্রস্তুত ছিলেন। এদিকে পাবনার আওয়ামী লীগের নেতা আমজাদ হোসেন পাকিস্তানি হানাদারদের দৃষ্টি এড়িয়ে পাবনার গ্রামে গ্রামে কৃষক-মজুরদের সংগঠিত করার কাজে লেগে পড়েন। ২৭ মার্চ পাক সৈন্যরা পাবনা পুলিশ ব্যারাকে প্রবেশ করে। সেখানে গিয়ে অস্ত্রাগার তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বাঙালি পুলিশদের নির্দেশ দেয়। পুলিশ বাহিনী এতে অস্বীকৃতি জানায়। পুলিশের সদস্যরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, অস্ত্রাগার কারও হাতে তুলে না দিতে ডিসি সাহেবের নির্দেশ রয়েছে। সেখানে প্রথমে বাকবিতণ্ডা, পরে গোলাগুলি হয়। এ যুদ্ধে চার পাক সেনা নিহত হয়। পরে পাক সেনারা পিছু হটে। পুলিশ ব্যারাক দখলে ব্যর্থ হয়ে রাতে পাকিস্তানি সেনারা যে আবার হামলা করতে পারে, এ আশঙ্কায় পুলিশ সদস্যরা ব্যারাকের আশেপাশে বাড়ির ছাদ ও পথের মোড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে আড়ালে থেকে পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করার জন্য ওত পেতে থাকে। সেদিন পুলিশ ব্যারাকের সদস্যদের সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন জেলখানার পুলিশ সদস্যরা। রাত সাড়ে ৪টায় পাকিস্তানি সেনারা চুপিসারে পুলিশ ব্যারাক আক্রমণ করে। বাঙালি পুলিশ সদস্যরা প্রথম আক্রমণ করেন। দু’পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি ও সংঘর্ষ বেধে যায়। অতর্কিতভাবে এ ধরনের প্রতিরোধ ঘটবে, তা পাক সেনারা সেদিন বুঝতে পারেনি। এ সংঘর্ষে ২১ পাক সেনা নিহত হয় এবং অন্যরা পালিয়ে যায়। ওইদিন বাঙালি পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজনও শহিদ হননি।
২৮ মার্চ, ২৭ সৈন্য পাবনা শহরের টেলিফোন একচেঞ্জ দখল করে রেখেছিল। এদিকে পাকিস্তানি হামলাকারীদের শিক্ষা দিতে গ্রামের কৃষক, শ্রমিক ও জনতা চারদিক থেকে লাঠিসোটা, বর্শা-বল্লম ও তীর-ধনুক নিয়ে পাক সেনাসহ টেলিফোন এক্সচেঞ্জটি ঘিরে ফেলেন। পাকিস্তানি সেনারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ভেতর থেকে বাঙালিদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে লাগল। তাদের গোলাগুলির কারণে বাঙালিরা সেদিন টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। তবে বাঙালি জনতার পরিকল্পনা ছিল, ওখানে আটকে পড়া শত্রুদের খাদ্যের মজুত শেষ হলে তাদের ঘায়েল করা সহজ হবে। ২৮ মার্চ সারারাত হানাদাররা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অবরুদ্ধ ছিল।
২৯ মার্চ আটকে পড়া শত্রু সেনাদের কাছ থেকে ওয়ারলেস টেলিফোনে বার্তা পেয়ে পাক সেনারা যুদ্ধবিমান নিয়ে তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসে। যুদ্ধবিমান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। বাঙালিরা এর আগে কোনোদিন স্বচক্ষে জেট বিমান দেখেননি। গোলাগুলির তীব্র শব্দে অসহায় বাঙালিরা এদিক-সেদিক ছুটতে থাকেন। এ সুযোগে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আটকে পড়া পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রাণভয়ে এদিক-সেদিক ছুটতে থাকে। এরই মধ্যে পাবনায় আটকে পড়া সৈন্যদের রক্ষা করতে রাজশাহী থেকে ট্যাংক, কামান ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ শতাধিক পাক সেনার বহর সেখানে এসে পৌঁছায়। একদিকে জড়ো হওয়া জনতাকে ভয় দেখাতে এবং ছত্রভঙ্গ করতে পাকিস্তানি জেট বিমান ওপর থেকে ছোঁ মেরে নিচে নেমে আসার পর আবার ওপরে ওঠে যায়। এ অবস্থায় গোলাগুলি ও হামলার মধ্যেও বাঙালি জনতা পাকিস্তানি সেনাদের ধাওয়া করেন। ওই সময় ১৩ পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ পাক সেনাদের গুলিতে ৪০ বাঙালি শহিদ হয়েছিলেন।
৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানে ঘোষিত আহ্বানে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করার জন্য তরুণ-যুবকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ গোপনে দেশব্যাপী অস্ত্র সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পাবনার ঈশ্বরদীর কৃষক, শ্রমিক, রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতাসহ বিভিন্ন জনের কাছে থাকা দেশীয় একনলা ও দুনলা ৪২টি বন্দুক সংগ্রহ করে রাখা হয়েছিল। এদিকে পাক সেনাদের কীভাবে উচিত শিক্ষা দেয়া যায়, সে বিষয়ে ডিলুবাহিনী (সাবেক ভূমিমন্ত্রী মরহুম শামসুর রহমান শরীফ) ঈশ্বরদী পাকশি রেলওয়ে মাঠে বসে পরিকল্পনা করছিল। এরই মধ্যে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক পাবনা আক্রমণ ও সেনাদের আটক করার খবর তাদের কাছে পৌঁছে যায়। বিলম্ব না করে তারা তখনই পাকশি রেলওয়ে মাঠ থেকে পাবনা শহরের দিকে রওনা হন। পথিমধ্যে তারা জানতে পারেন, পাকিস্তানি সেনাদলের কনভয় পাবনা থেকে হতাহত সৈন্যদের উদ্ধার করে ঈশ্বরদীর দাপুনিয়া মাধপুর হয়ে রাজশাহীর দিকে ফিরে যাচ্ছে।
ডিলুবাহিনী পাক সৈন্যদের ধরাশায়ী করার মতো এমন সুযোগকে সেদিন হাতছাড়া করতে চায়নি। তারা সিদ্ধান্ত নিল মাধপুরে পাক সেনাদের পথ আটকে দিয়ে তাদের খতম করার জন্য। একটি প্রকাণ্ড বটগাছের আড়ালে থেকে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধমূলক আক্রমণ করার মতো উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করা হয়। ডিলুবাহিনীর সংগৃহীত ৪২টি অস্ত্র, পাবনা থানা থেকে পাওয়া আরও সাতটি আধুনিক অস্ত্র, হাতের তৈরি বোমা, তীর-ধনুক, বল্লম, হাসুয়া ও বাঁশ নিয়ে হাজার হাজার জনতা আগ্রাসী পাকিস্তানি মিলিটারি সেনাদের ওপর সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ডিলুবাহিনীর আক্রমণে সেদিন মাধপুরে পাকিস্তানি সেনা মেজর আসলামসহ এক ডজন পাক আর্মি নিহত হয়। পাকিস্তানি আর্মির এ বহরের কারও রাজশাহী যাওয়ার রাস্তা চেনা না থাকায় মাধপুরের হামলায় তাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায় এবং বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ আসায় তারা তাদের সাঁজোয়া যুদ্ধযান ফেলে রেখে যে যেভাবে পারে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তানি বহরের শতাধিক সৈন্যের সব সৈন্য রাজশাহী পৌঁছানোর আগেই বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণে মারা যায়। সেই যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন ঈশ্বরদীর তৎকালীন ছাত্রনেতা রাজু, হাশেম মল্লিক, আবদুর রাজ্জাক, ওহিদুর রহমান, আব্দুল গফুর, নূরুল ইসলাম, আলী আহম্মদ, নবাব আলী, হামির উদ্দিন ও ফরমান সরদারসহ ১৭ মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়া প্রতিরোধ যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন অর্ধশতাধিক নিরীহ গ্রামবাসী। পাকিস্তানি বাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিতে এ বীর যোদ্ধারা সেদিন নিহত হয়েছিলেন। পাবনার প্রথম প্রতিরোধমূলক জনযুদ্ধে পাকিস্তানি দুই শতাধিক সৈন্য নিহত হয়েছিল।
প্রতিবছর ২৯ মার্চ মাধপুরে শহিদদের স্মরণে বিশেষ দিবস পালিত হয়। তার কিছুদিন পরে ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার গঠিত হলো, মুক্তিযোদ্ধারা সুসংগঠিত হলো, তবুও মাধপুরের ২৯ মার্চের সেইদিনের অদম্য বিশাল আত্মত্যাগ জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। পাবনার প্রথম সার্থক সম্মুখ প্রতিরোধযুদ্ধ ছিল এটি। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা জেলা শত্রুমুক্ত ছিল।
পিআইডি নিবন্ধ