জলবায়ু শরণার্থী: বৈশ্বিক সংকট

নাজমুন নাহার জেমি: জলবায়ু শরণার্থী এখন অনেকের কাছেই পরিচিত। জলবায়ু শরণার্থীরা পরিবেশের আকস্মিক বা ক্রমপরিবর্তনের কারণে তাদের জীবনযাত্রার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে; যার ফলে তারা দেশে বা দেশের বাইরে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে বাধ্য হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যায়,  অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, দাবানলে বনবাদাড় ও মানববসতি উজাড় হওয়া, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, উপকূলের বাড়িঘর ও জমিজমা তলিয়ে যাওয়া, দেশের নদ-নদী ও খাল-বিলের পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া কিংবা লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে ফসলের জমিতে সেচের পানির অভাব দেখা দেয়া প্রভৃতি কারণে মানুষ এখন এক জলবায়ু সংকটকাল অতিক্রম করছে। জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন সংকট শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়,  এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বর্তমানে আমরা যতটা খরা, অতিবৃষ্টি, প্রচন্ড গরম, ঘূর্ণিঝড় দেখছি। কয়েক দশক আগেও পৃথিবীতে জলবায়ু সংকটের প্রভাব ছিল না। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ হলো জলবায়ু শরণার্থী। অস্ট্রেলিয়ার ইন্টারন্যাশনাল থিংক ট্যাংক আইইপির ঘোষণা মতে, আবহাওয়া সম্পর্কিত দুর্যোগের কারণে চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি বিশ্বে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখে পৌঁছাতে পারে।

মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষ জলবায়ু শরণার্থীর শিকার হলেও, এখন পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতেও হচ্ছে। গত বছর মধ্য আমেরিকার হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা ও এলসালভাদর দুটি বড় ধরনের হারিকেনের শিকার হয়। এটি মেক্সিকো সীমান্ত ধরে চলে যায় আমেরিকার সীমান্ত পর্যন্ত। বর্তমানে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল এখন ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। পুড়ে বিনষ্ট হচ্ছে বনাঞ্চল, ধ্বংস হচ্ছে মানব বসতিও। মানুষ পরিণত হচ্ছে জলবায়ু শরণার্থী হিসেবে। বিগত তিন দশকে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের ১৭ শতাংশ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হবে। সমুদ্রপৃষ্টের তাপমাত্রা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অল্প সময়ের মধ্যে অনেক দেশ মালদ্বীপের মতো তলিয়ে যাবে। উপকূলীয় এলাকার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে ঠাঁই নিচ্ছে শহরের বস্তিতে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে নানা দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। জলবায়ু ও পরিবেশের ক্ষতি নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি বড় বিতর্কের বিষয় হচ্ছে, কে বা কারা অধিক কার্বন নিঃসরণ ও জলবায়ু ক্ষতির জন্য দায়ী। উন্নত দেশগুলো এজন্য শিল্পোন্নত ও অধিক জনসংখ্যার দেশ চীন-ভারতকে দায়ী করে থাকে। তাদের যুক্তির এদের জনসংখ্যা বেশি ভোগও বেশি সুতরাং এরাই পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য অধিক দায়ী; অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বক্তব্য শিল্প বিপ্লবের পর উন্নত দেশগুলো প্রচুর জ্বালানি ব্যবহার করে মুনাফার নামে পরিবেশ ও জলবায়ুর অধিক ক্ষতি করেছে এবং সে কাজটি করা হয়েছে কয়েকশ বছর ধরে তেল-গ্যাস-কয়লা পোড়ানোর মাধ্যমে। চীন-ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিল্পায়নের ইতিহাস ৫০-৬০ বছরের অধিক সময় ধরে। অতএব পরিবেশ বিপর্যয়ের দায় তাদেরই নিতে হবে। প্রধানত শিল্পোন্নত দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে তেল-গ্যাস-কয়লা-কয়লা পোড়ানোর ফলে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিকারক কার্বন পরিবেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলস্বরূপ পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হচ্ছে।

বিশ্বের সব দেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু রক্ষায় কার্বন নিঃসরণ কমানোর (১.৫ শতাংশ) কথা বলা হচ্ছে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে তা শূন্যের কোটায় নিয়ে আসার অঙ্গীকার করার জন্য গ্লাসগোর সম্মেলনে আহ্বান করা হয়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণকারী দেশ চীন (২৮ শতাংশ), তার পরের অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, রাশিয়া। জলবায়ু রক্ষায় চীনের একটা দায় বেশি রয়েছে। কারণ কার্বন নিঃসরণে দেশটি বেশি দায়ী। জলবায়ু শরণার্থী কোনো শরণার্থীর আইনি সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে সত্যিই যুৎসই নয়। পরিবেশগত সমস্যা থেকে পালিয়ে আসা বিপুলসংখ্যক মানুষ স্বল্প দূরত্বে চলে যায়। সাধারণ সহিংসতা বা ঘটনাগুলো জনসাধারণের শঙ্কাকে মারাত্মকভাবে বিঘিœত করার কারণে জলবায়ু শরণার্থীরা বাড়ি ত্যাগ করছে না। ১৯৮১ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক এবং আইনগত বাধ্যবাধকতা সংঘটিত হওয়ার পর শরণার্থী সংজ্ঞাটি প্রসারিত হলেও পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে যারা পালাতে বাধ্য হয়েছেন তাদের এখনও শরণার্থীদের মতো আইনি সুরক্ষা দেয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, শরণার্থীদের বিষয়ে জাতিসংঘের ১৯৫১ সালের সম্মেলনে পুনর্লিখনের অসুবিধার কারণে এই শরণার্থীদের  ‘জলবায়ু শরণার্থী’ হিসেবে বিবেচনা করা ভালো। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি রায় দিয়েছে, জলবায়ু সংকটের প্রভাবে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের তাদের দত্তক দেশগুলো নিজ দেশে ফিরতে বাধ্য করা যাবে না।

তাই আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে। তাহলেই ‘জলবায়ু শরণার্থী’ অভিশাপ থেকে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ মুক্তি পাবে।

শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০