ইসমাইল আলী: ঘাটতি মেটাতে ৪০টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন কিনবে রেলওয়ে। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রতিটি ইঞ্জিনের দাম ধরা হয় (ভ্যাট-শুল্ক ছাড়া) ৩১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। চার মাসের ব্যবধানে দুই দফায় এগুলোর দাম বাড়ানো হয়েছে চার কোটি আট লাখ টাকা বা ১৩ শতাংশ। নতুন হিসাবে প্রতিটি ইঞ্জিনের দাম পড়ছে ৩৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। যদিও ইঞ্জিনগুলোর ভারবহন ক্ষমতা (এক্সেল লোড) আগের চেয়ে কমানো হচ্ছে।
এদিকে ছোট প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ কম রেলওয়ের। এজন্য দুই দফায় এককপ্রতি দামের পাশাপাশি ইঞ্জিনের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে ১৫টি। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে আরও চারটি কম্পোনেন্ট। এতে একটি মেগা প্রকল্পে রূপ নিয়েছে ইঞ্জিন কেনার উদ্যোগ। প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) চূড়ান্তে সম্প্রতি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে।
তথ্যমতে, ৪০টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৫৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ইঞ্জিনপ্রতি দাম পড়বে গড়ে ৫১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর ভ্যাট-কর ছাড়া দাম ধরা হয়েছে ৩৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে এক্ষেত্রে প্রতিটি ইঞ্জিনের দাম বেশি ধরা হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। গত ফেব্রুয়ারিতে ইঞ্জিনপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছিল ভ্যাট-করসহ ৪২ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
রেলওয়ে জানায়, ২০১২ সালে তিন হাজার ১০০ হর্সপাওয়ারের ১৬টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন কেনা হয়েছিল। এতে ভ্যাট-শুল্ক ছাড়া দাম পড়ে ২৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। তার ওপর বছরপ্রতি ৫ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি ধরে পাঁচ বছরে ২৫ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে। পাশাপাশি এবার তিন হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার ৩০০ হর্সপাওয়ার ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে। এছাড়া উচ্চক্ষমতার জন্য আরও ২০ শতাংশ ব্যয় অতিরিক্ত ধরা হয়েছে।
যদিও পাঁচ বছরে ২৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধির কোনো ধরনের যুক্তি নেই বলে মনে করেন রেলওয়ে প্রকৌশলীরা। তারা জানান, ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনায় গত বছর দরপত্র আহ্বান করে রেলওয়ে। ২০১১ সালে ইঞ্জিনগুলো কেনার প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। সে সময় দাম ধরা হয় ভ্যাট-কর ছাড়া ২০ কোটি টাকা। তবে গত বছর দরপত্রে ২০ কোটি টাকারও কম প্রস্তাব করে স্পেনভিত্তিক সুইস কোম্পানি স্ট্যাডলার রেইল। এ হিসেবে ছয় বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে ইঞ্জিনের মূল্য বাড়েনি।
এদিকে ছয় মাসের ব্যবধানে ইঞ্জিনপ্রতি দাম ৪ কোটি টাকার বেশি দাম বাড়ানো হলেও কমানো হচ্ছে এগুলোর ভারবাহন ক্ষমতা। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রস্তাবিত প্রকল্পটিতে ইঞ্জিনের প্রতিটি চাকায় এক্সেল লোড ধরা হয় সাড়ে ২২ টন। আর এখন প্রতিটি চাকায় এক্সেল ধরা হয়েছে সাড়ে ১৮ টন। এক্সেল লোড কমায় এগুলোর কোচ (বগি) টানার ক্ষমতা তুলনামূলক কম হবে। এতে ইঞ্জিনপ্রতি ব্যয় বাড়ার কোনো যুক্তি নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে ইঞ্জিনগুলো কেনা হবে। তাদের স্পেসিফিকেশনের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক বাজারদর যাচাইপূর্বক ইঞ্জিনের একক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে এডিবির ঋণের অংশও নির্ধারণ করা হয়েছে। তারা এ প্রস্তাবে সম্মতিও প্রদান করেছে।
রেলওয়ের প্রকৌশলীরা বলছেন, ২০১২ সালে সর্বশেষ ব্রডগেজ ইঞ্জিন কেনা হয়। তবে ভারতের ঋণের শর্তই ছিল, দেশটি থেকে ইঞ্জিন কিনতে হবে। তাই দাম বেশি হলেও কোনো বিকল্প ছিল না। তবে এবার এডিবির ঋণে ইঞ্জিন কেনায় উš§ুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে। তাই কম দর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে অতিরিক্ত দরপ্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে গত ফেব্রুয়ারিতে ২৫টি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সে সময় এর ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৭২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। মার্চে ইঞ্জিনের সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ৩০টি। এতে ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৪৪৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এবার এ সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪০টি।
রেলওয়ে ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ প্রসঙ্গে জানানো হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এডিবি ৩৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। আর প্রকল্পটির প্রাক্কলনে ঋণ সহায়তা ধরা হয়েছে ৩০ কোটি ১৯ লাখ ডলার। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইঞ্জিনের সংখ্যা বাড়িয়ে ৪০টি করা হয়।
বৈঠকে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মো. শামছুজ্জামান জানান, বর্তমানে ব্রডগেজ ইঞ্জিনের স্বল্পতা রয়েছে। এছাড়া ভবিষ্যতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ব্রডগেজ ইঞ্জিনের চাহিদা আরও বাড়বে। তাই ৪০টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন কেনা যেতে পারে।
শুধু ইঞ্জিনের সংখ্যা বাড়ছেই না, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কয়েকটি অংশ। এর মধ্যে রয়েছে ৭৫টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান, ৪০০টি মিটারগেজ ও ৩০০ ব্রডগেজ কাভার্ড ভ্যান, ১৮০টি মিটারগেজ ও ১২০টি মিটারগেজ খোলা (বিকেসি) ভ্যান, ডিজেল ইঞ্জিন ও ডেমুর জন্য ওয়ার্কশপ নির্মাণ, কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা ও ঢাকা লোকোশেড আধুনিকায়ন এবং এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং সিস্টেম অপারেশন ও মেইনটেন্যান্সের সম্ভাব্যতা যাচাই।
সব মিলিয়ে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় চার হাজার ১১৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে এডিবি ঋণ দেবে তিন হাজার ৪৪১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। আর সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে ৬৭৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। প্রকল্পটিতে লাগেজ ভ্যান কেনায় ব্যয় হবে ৫০৯ কোটি ২০ লাখ, কাভার্ড ও খোলা ভ্যান কেনায় এক হাজার ১২৭ কোটি ১০ লাখ এবং বাকি অংশের জন্য ৪২২ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
Add Comment