মো. রায়হান আলী: ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় কোনো মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা বা জরিমানা প্রদানের আদেশ দেন আদালত। কিন্তু কোনো মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে দোষী সাব্যস্ত করা সত্ত্বেও যদি আসামি স্বাভাবিকভাবে কারামুক্ত থেকে পারিবারিক জীবন-যাপন করে, তাহলে এটা কেমন দেখায়? এমন প্রশ্ন হয়তোবা অনেকের মনে জাগতে পারে। বিষয়টায় আচমকা খটকা লাগলেও ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় এমন বিধান যুক্ত আছে। আর এই বিধানটা হলো অভিযুক্ত আসামিকে তার কৃত অপরাধের সংশোধনের জন্য প্রবেশনে মুক্তি দেয়া।
প্রবেশন অর্থ পরীক্ষাকাল। প্রবেশন বলতে কোনো অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তি স্থগিত রেখে, কারারুদ্ধ না রেখে বা কোনো প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ না করে সমাজের সব সামাজিকতার সঙ্গে মানিয়ে চলার সুযোগ প্রদান করাকে বোঝায়। প্রবেশন ব্যবস্থায় প্রথম ও লঘু অপরাধে আইনের সঙ্গে সংঘর্ষে বা সংস্পর্শে আসা শিশু-কিশোরেরা বা অন্য কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে প্রথম ও লঘু অপরাধের দায়ে কারাগারে বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে না রেখে আদালতের নির্দেশে প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে এবং শর্তসাপেক্ষে তার পরিবার ও সামাজিক পরিবেশে রেখে কৃত অপরাধের সংশোধন ও তাকে সামাজিকভাবে একীভূতকরণের সুযোগ দেয়া হয়। প্রবেশন মূলত একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক সংশোধনী কার্যক্রম। এটি অপরাধীর বিশৃঙ্খল ও বেআইনি আচরণ সংশোধনের জন্য একটি সুনিয়ন্ত্রিত কর্মপদ্ধতি। এখানে অপরাধীকে পুনঃঅপরাধ রোধ ও একজন আইনমান্যকারী নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য সহায়তা করা হয়। অপরাধীকে আদালতের শর্তসাপেক্ষে প্রবেশনে মুক্তি দেয়া হয়।
ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অপরাধের ধরন অনুযায়ী কারাবাস বা জরিমানার বিধান আছে। অপরাধীকে কারাবাসের মূল উদ্দেশ্য হলো অপরাধী যেন একই ধরনের অপরাধে কিংবা অন্য কোনো অপরাধে নিজেকে জড়াতে না পারে। এছাড়া অপরাধীকে কারাবাসে রাখলে সে আগের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে না বা অপরাধপ্রবণ মানসিকতা নিবৃত্ত হয়। সেজন্যই অপরাধীকে রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তি-সমাজের বিরুদ্ধে তার কৃত অপরাধের প্রতিশোধ হিসেবে পরিবার তথা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে (কারা অভ্যন্তরে) তার শরীর ও মনের ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরোপ করাই হলো মূল উদ্দেশ্য।
এখন প্রশ্ন হলো এভাবে অপরাধীরা কারা অভ্যন্তরে অন্তরীণ থেকে কতটা নিজেকে সংশোধন করতে পারে? নিশ্চয় প্রশ্নটা অনেকটা বিদঘুটে হতে পারে অনেকের মনে। সমাজে অপরাধ কমানোর জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে অপরাধের ধরন অনুযায়ী ধাপে ধাপে সাজার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সাজার মেয়াদ প্রয়োগ হচ্ছে, অপরাধীরাও সাজা ভোগ করছে। কারা অভ্যন্তরে রেখে হাজতি বা কয়েদিরা কতটা নিজেকে সংশোধন করতে পেরেছে, সেটাই অনেকের মনে প্রশ্ন। আমরা হয়তোবা অনেকেই দেখছি, কারাভোগের পরে অনেক অপরাধী আবার সমাজে এসে আগের অপরাধে অনায়াসে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে, কিংবা আগের অপরাধের চেয়েও বড় কোনো অপরাধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। অপরাধীরা যদি কারা অভ্যান্তরে থেকে সম্পূণভাবে ভালো হয়ে যেত, তাহলে অপরাধীর সংখ্যা ক্রমাগত কমতে থাকত। কিন্তু অপরাধীরা কারামুক্ত হওয়ার পর তাদের বেশিরভাগই আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে তাদের অপরাধের পিসিপিআর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্যই অপরাধীকে বিকল্প উপায়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফিরে আসার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে প্রবেশনে মুক্তি।
প্রবেশন আইনের ৫ ধারার আওতায় ‘দণ্ডবিধি ১৮৬০’-এ ঘোষিত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ও সশস্ত্র বাহিনী-সম্পর্কিত এবং ডাকাত, দস্যুতা, গুরুতর ধরনের চুরি, সিঁদকাটা, বিষপ্রয়োগ-সহ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ডের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত পুরুষ প্রবেশনে মুক্তির জন্য উপযুক্ত হবেন না। তবে নারীরা শুধু মৃত্যুদণ্ডের অপরাধ ব্যতীত সব অপরাধের ক্ষেত্রে প্রবেশনে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিবেচিত হতে পারে।
‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ (১৯৬৪ সালে সংশোধিত)’-এর আওতায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত আদালত প্রথম ও লঘু অপরাধে জড়িত শিশু-কিশোর বা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে শর্তসাপেক্ষে এক থেকে তিন বছরের জন্য প্রবেশন মঞ্জুর করতে পারে। তবে শিশু-কিশোরদের জন্য এ আইনগত সুবিধা অগ্রাধিকার পায়। ‘শিশু আইন ২০১৩’-এর আওতায়ও শিশু-কিশোরেরা শিশু আদালতের মাধ্যমে প্রবেশন ব্যবস্থার সুযোগ পায়। উপর্যুক্ত দুটি আইনের আওতায় বিজ্ঞ বিচারকদের সহায়তা করার জন্য আদালতের শর্তাবলি যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য এবং তত্ত্বাবধান ও সংশোধনী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন অফিসারদের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের জে-০১/২০১৯ নম্বর সার্কুলার জারির মাধ্যমে দেশের সব অধস্তন আদালতকে প্রবেশন-সংক্রান্ত বিধানগুলো সঠিকভাবে প্রতিপালনের তাগিদ প্রদান করা হয়।
এই প্রবেশন আইন প্রতিপালন স্বরূপ ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর সুনামগঞ্জের শিশু আদালতের বিজ্ঞ বিচারক একসঙ্গে ৭০ শিশুকে দোষ স্বীকারের পর মুক্তি দিয়েছিলেন, যেটি সারাদেশেই সাড়া তুলেছিল। জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো এই খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করার মাধ্যমে জনমতের এই প্রতিচ্ছবিই ফুটে ওঠে যে, অধুনা এই দেশ ও সমাজ প্রবেশনকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে। এই আদালত ২০২০ সালের অক্টোবরে ১০টি মামলায় ১৪টি শিশুকে এবং ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৩৫টি মামলায় ৪৯ শিশুকে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছেন। ( তথ্য সূত্র: আসক বুলেটিন, ২০২১)
গত ২২ মার্চ প্রবেশন আইনের আওতায় এক যুবকের দেয়া ছয় মাসের সাজা স্থগিত করে জেলখানায় দাগি আসামিদের সঙ্গে নয়, পারিবারিক পরিবেশে থেকে সংশোধন হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন আদালত। সাতক্ষীরার বিজ্ঞ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতের বিচারক ইয়াসমিন নাহার ওই আদেশ দেন। প্রবেশনে মুক্তি পাওয়া আসামি জহিরুল সরদার (২৫) আশাশুনির শ্বেতপুর গ্রামের আব্দুর গফুর সরদারের ছেলে। আশাশুনির শ্বেতপুর গ্রামের গ্রাম্য ডাক্তার বলরাম বিশ্বাস হুমকি-ধমকি দেয়ার অভিযোগে আসামি জহিরুল সরদারের বিরুদ্ধে আশাশুনি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পরে সেটি তদন্ত শেষে আদালতে বিচারের জন্য পাঠানো হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতের বিচারক ইয়াসমিন নাহার আসামিকে ছয় মাসের সাজা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় আসামি তার প্রথমবারের অপরাধের জন্য আদালতের কাছে ক্ষমা চান এবং ভবিষ্যতে একই ধরনের অপরাধ আর করবেন না বলে অঙ্গীকার করেন। ফলে বিচারক বেশ কিছু শর্তসাপেক্ষে প্রবেশন আইনের আওতায় তার দেয়া সাজা স্থগিত করে পারিবারিক পরিবেশে বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে সংশোধন হওয়ার সুযোগ করে দেন। (সূত্র: দৈনিক পত্রদূত, সাতক্ষীরা)
অপরাধীকে প্রবেশনে মুক্তির আদেশ দেশের অনেক আদালতই দিচ্ছেন। এ ধরনের আদেশ নিত্যনৈমিত্তিকভাবে দিচ্ছেন অধস্তন আদালতগুলো। পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা করতে হবে, এমন মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে সবার মধ্যে। অপরাধীকে ঘৃণা করে কিংবা সম্পূর্ণ সংশোধনের জন্য ১৪ শিকের ভেতরে রাখলেই যে অপরাধী আর অপরাধে জড়াবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। তাই এমন মানসিকতা ও নিয়মের বিকল্প ধরনের নামই হচ্ছে প্রবেশনে মুক্তি। প্রবেশনে মুক্তির কার্যক্রম বৃদ্ধিতে আরও উদ্যোগী হতে হবে বিচার-সংশ্লিষ্টদের।
আইনজীবী ও মুক্ত লেখক
advrayhan520@gmail.com