নজরুল ইসলাম: আরিফুর রহমান (৭০) একজন অবসরপ্রাপ্ত সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি)। ইন্সপেক্টর হিসেবে প্রেষণে দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে চাকরি করেছিলেন। ১১ বছর ছিলেন এখানে। তারপর পুলিশে ফিরে পদোন্নতি পান। হন এএসপি। তারপর অবসরে যান। এখন ঢাকার মতিঝিলের ফকিরেরপুলের ডিআইটি এক্সটেনশন রোডে বাস করেন। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলায়। নিজের নামে ও বেনামে বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জন ও ভোগদখলে রেখেছেন। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে মিথ্যা তথ্য দেন। তিনি ২০ লাখ ২৭ হাজার ৮১৮ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন, যা দুদক আইন, ২০০৪-এর ২৬(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এছাড়া বৈধ আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ২২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৬৪ টাকা মূল্যের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জন করে তা ভোগদখলে রেখেছেন, যা দুদক আইন, ২০০৪-এর ২৭(২) ও ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দুদকের দায়ের করা মামলা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তার বিরুদ্ধে গত ৭ মার্চ সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (ঢাকা-১) একটি মামলা (নম্বর ১১) দায়ের করেছেন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দুদক কমিশন মামলাটি দায়েরের অনুমোদন দিয়েছে।
এজাহারে বলা হয়েছে, দুদকের নোটিস পেয়ে ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট আরিফুর রহমান সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, ঢাকার পীর ইয়ামেনী মার্কেটে জি-২০ নম্বর দোকানটি বরাদ্দ নেয়ার জন্য তিনি ১৯৯০-৯৪ সাল পর্যন্ত তিন লাখ ২৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। অথচ সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। এখানে তিনি দুই লাখ টাকা মূল্যের সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। তার ছেলে তৌহিদ হোসেনের নামে খদ্দর বাজার শপিং কমপ্লেক্সে দোকানের জন্য তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। কিন্তু সম্পদ বিবরণীতে তিনি উল্লেখ করেছেন এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এখানে তিনি এক লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন।
এজাহারে বলা হয়েছে, ২৪ লাখ ৬৮ হাজার ৫৯৪ টাকার স্থাবর সম্পদ এবং ৩০ লাখ ৫৯ হাজার ৯৮৪ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট ৫৫ লাখ ২৮ হাজার ৫৭৮ টাকার সম্পদের হিসাব দেখিয়েছেন। যাচাইকালে স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে ২০ লাখ ২৭ হাজার ৮১৮ টাকার সম্পদ বেশি পাওয়া গেছে। তার মানে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মোট মূল্য ৭৫ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯৬ টাকা। অর্থাৎ তিনি সম্পদ বিবরণীতে ২০ লাখ ২৭ হাজার ৮১৮ টাকা মূল্যের সম্পদের মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন, যা দুদক আইন, ২০০৪-এর ২৬(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
১৯৭৮ সালে ঢাকার ফকিরের পুলে আরিফুর রহমানের ছোট ভাই মোখলেছুর রহমান ২ দশমিক ৬৬ অযুতাংশ জমি কেনেন। পরে আরিফুর রহমানের ছেলে আহমেদ হোসেন মামুনকে ১৯৮০ সালের দিকে হেবা করে দেন। ১৯৮৪-৮৫ সালে সাততলা-বিশিষ্ট ভবনের পঞ্চম তলা পর্যন্ত নির্মাণ করেন, যাতে ব্যয় হয়েছে ২২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯৬ টাকা। বাড়ি নির্মাণের জন্য ঋণ নেয়ার আগ পর্যন্ত ব্যয় করা ২৭ হাজার ৫২২ টাকা যোগ করলে দাঁড়ায় ২৩ লাখ ২১ হাজার ৮১৮ টাকা। হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত নির্মাণের জন্য ছয় লাখ ৪৪ হাজার টাকা ঋণ নেন। অথচ তার আয়কর নথি অনুসারে তিনি ওই ঋণ দিয়ে পঞ্চম তলা পর্যন্ত সম্পন্ন করার জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের পরিমাপ অনুসারে তাকে ব্যয় করতে হয়েছে ২৩ লাখ ২১ হাজার ৮১৮ টাকা।
তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত অর্জিত সম্পদের মূল্য এক লাখ ৭৬ হাজার ৯৪ টাকা। ১৯৮৪-৮৫ সালে নির্মিত বাড়ির জন্য ব্যয় হয় ২৩ লাখ ২১ হাজার ৮১৮ টাকা। তার অর্জিত সম্পদের তৎকালীন মূল্য ২৪ লাখ ৯৭ হাজার ৯১২ টাকা, যার বর্তমান মূল্য কয়েক কোটি টাকা। এছাড়া অস্থাবর সম্পদের মধ্যে পূর্বাচলে বহুমুখী সমবায় সমিতিতে ১৯৮৮ সালের ১ জানুয়ারি ৫০ হাজার টাকা জমা করা হয়। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তার অর্জিত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মোট মূল্য ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ৯১২ টাকা।
আরিফুর রহমানের বৈধ আয় হিসেবে বেতন-ভাতা ও বাড়িভাড়ার আয় ছিল চার লাখ ৩৫ হাজার ২৭ টাকা। এর বাইরে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে বাড়ি নির্মাণের জন্য ছয় লাখ ৪৪ হাজার টাকা ঋণ নেন। আয়কর নথি ও তার বক্তব্য অনুসারে ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়। প্রতি বছর ৫৬ হাজার ১৩৬ টাকা করে ১৯৯১-৯২ সাল পর্যন্ত সাত বছরে মোট তিন লাখ ৯২ হাজার ৯৫২ টাকার কিস্তি পরিশোধ করেন। সেই হিসেবে সম্পদ অর্জনের জন্য তার কাছে থাকার কথা দুই লাখ ৫১ হাজার ৪৮ টাকা। অথচ এই সময় তিনি ২৫ লাখ ৪৭ হাজার ৯১২ টাকা মূল্যের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। ওই সময়ে (১৯৯২) তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদের মূল্য ২২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৬৪ টাকা। অর্থাৎ তিনি ২২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৬৪ টাকার জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জন ও ভোগদখলে রেখে দুদক আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।