ইসমাইল আলী: পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকা থেকে মাওয়া, ভাঙ্গা ও নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ। ২০২২ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। ২০১৬ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। তবে ছয় বছর পেরুলেও এখনও জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়নি। আর সময়মতো জমি বুঝে না পাওয়া প্রকল্পটির বিলম্বিত হওয়ার কারণ বলে মনে করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (সিআরইসি)।
বাংলাদেশ-চীন সরকারের যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ১৫তম বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এ সময় জানানো হয়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটির ৯৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বাস্তবায়নের কথা ছিল। তবে বাস্তবে কাজ শেষ হয়েছে ৫৬ শতাংশ।
বৈঠকে জানানো হয়, পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্পের জন্য দুই হাজার ৪৬৪ একর জমি প্রয়োজন। এর মধ্যে দুই হাজার ৮০ একর অধিগ্রহণ করা হয়েছে, যার প্রায় পুরোটাই সিআরইসির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি জমিও অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াধীন আছে। যদিও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন বিলম্বের জন্য জমি অধিগ্রহণ বিলম্বকেই দায়ী করেছে সিআরইসি।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প মনিটরিং কমিটির বৈঠকেও পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে চ্যালেঞ্জ হিসেবে জমি অধিগ্রহণের সর্বশেষ চিত্র তুলে ধরা হয়। বৈঠকে জানানো হয়, ঢাকা জেলায় এলএ কেস নং ০৫.২৮.১৩/২০-২১-এর আওতায় তিন দশমিক ৪৭৬৩ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ২০২১ সালের ৪ আগস্ট ৮ ধারা জারি করা হয়েছে। তবে দখল হস্তান্তর হয়নি। এছাড়া এলএ কেস নং ০৫.২৯.১৩/২০-২১-এর আওতায় ১৪ দশমিক ৭৬২৮ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর ৭(১) ধারা জারি করা হয়েছে। তবে জমির মূল্য কত হবে, জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে তার চূড়ান্ত প্রাক্কলন পাওয়া যায়নি।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলায় এলএ কেস নং ০৯/২০২০-২১-এর আওতায় দুই দশমিক ৭৩২১ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে চূড়ান্ত প্রাক্কলন পাওয়া যায়নি। আর মাদারীপুর জেলায় এলএ কেস নং ০৫/২০২০-২১-এর আওতায় তিন দশমিক ৪৩৯২ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ২০২১ সালের ১৫ মার্চ ৭(১) ধারা জারি করা হয়েছে। তবে জমির মূল্য কত হবে, জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে তার চূড়ান্ত প্রাক্কলন পাওয়া যায়নি।
একই অবস্থা নড়াইলের ১১ দশমিক ৮০২১ একর জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে। সর্বশেষ গত বছর ২৩ আগস্ট থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তবে জমির মূল্য কত হবে, জেলা প্রশাসকের দপ্তর হতে তার চূড়ান্ত প্রাক্কলন পাওয়া যায়নি। আর গোপালগঞ্জের ১৩ দশমিক ২১৭৮ একর জমির জন্য জেলা প্রশাসকের চাহিদা মোতাবেক ভূমির সংশোধিত প্রস্তাব প্রকল্প দপ্তর থেকে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
অপরদিকে নড়াইলের চর বকজুরিতে এলএ কেস নং ০১/২০২০-২১-এর আওতায় ১১ দশমিক ১৭৫৪ একর জমির জন্য সর্বশেষ গত ২৭ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একটি সভা হয়েছে। সভায় জানানো হয়, চলমান আরএস জরিপ শেষ হলে জমির মালিকানা নিশ্চিত হওয়া যাবে। জরিপ শেষ হবে চলতি বছর ডিসেম্বরে। জমির মালিকানা-সংক্রান্ত জটিলতা থাকায় ঠিকাদারকে সাইট হস্তান্তর করা যাচ্ছে না। বর্তমানে এ জমি অধিগ্রহণে জটিলতা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
তথ্যমতে, প্রকল্পটির আওতায় ১৬৯ কিলোমিটার মূল রেলপথ ছাড়াও ৪৩ দশমিক ২২ কিলোমিটার লুপ লাইন ও তিন কিলোমিটার ট্রিপল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২৩ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার এলিভেটেড (উড়াল) রেলপথ, ৫৮টি মেজর ও ২৭৪টি মাইনর সেতু নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ২৯টি লেভেল ক্রসিং গেট, ১৪টি স্টেশন নতুন নির্মাণ ও ছয়টি আধুনিকায়ন এবং ১৭টি স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে। আর প্রকল্পটির অধীনে ১০০টি ব্রডগেজ কোচও কেনা হবে।
বাংলাদেশ-চীন সরকারের যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠকে জানানো হয়, প্রকল্পটির আওতায় অগ্রাধিকারভুক্ত সেকশন ছিল মাওয়া-ভাঙ্গা। এ অংশটি ৯১৩ দিনে নির্মাণের কথা ছিল। তবে এক হাজার ২৭৪ দিন পেরুলেও বাস্তবায়িত হয়েছে ৭৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। ঢাকা-মাওয়া সেকশনটি নির্মাণের কথা ছিল এক হাজার ৩৬৬ দিনে। এ পর্যন্ত ওই অংশটির কাজ হয়েছে ৫৩ শতাংশ। আর ভাঙ্গা জংশন থেকে যশোর পর্যন্ত সেকশনটি এক হাজার ৬৪৩ দিনে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। এ পর্যন্ত ওই অংশের কাজ হয়েছে ৪৮ শতাংশ। এছাড়া যাত্রীবাহী কোচ কেনার অগ্রগতি ১০ শতাংশ।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুতই তা সম্পন্ন হয়ে যাবে। তবে নড়াইলের জমি নিয়ে নিয়ে কিছু জটিলতা আছে। সেটা বিলম্বিত হতে পারে। বিষয়টি সমাধানে কাজ করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ৩ মে অনুমোদন করা হয়। সে সময় এর নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ২২ মে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। সে সময় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা (৪৯৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলার)। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সিআরইসির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি সই হয় ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট। তবে চুক্তিটি কার্যকর হয় ২০১৮ সালের ৩ জুলাই। চুক্তিমূল্য ছিল ৩১৩ কোটি ৮৮ লাখ ডলার।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে ২৬৬ কোটি ৭৯ কোটি ডলার। ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল এ চুক্তি সই হয়। বাকি ২৩০ কোটি ৯৫ লাখ ডলার বাংলাদেশ সরকার সরবরাহ করবে। আর প্রকল্পটির পরামর্শক হিসেবে যৌথভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। এ-সংক্রান্ত চুক্তি সই হয় ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটির নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর।