হামিদুর রহমান: স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই ব্যবসা করছে দেশের জনপ্রিয় রিটেইল চেইন শপ ‘স্বপ্ন’। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন আউটলেটে মাছ, মুরগি, গরুর ও খাসির মাংস কাটার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে একই ছুরি ও চপিং বোর্ড, যা পণ্যের গুণগত মান নষ্ট করছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে ক্রেতাদের। তারা অর্থ ব্যয় করেও সাধারণ বাজারের থেকে নিন্মমানের মাছ, মুরগি, গরু ও খাসির মাংস পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী মাছ, মুরগি, গরু ও খাসির মাংসের জন্য পৃথক কাউন্টার থাকবে। এসব পণ্যের জন্য পৃথক সেলসপারসন থাকে। কোনো কারণে একই সেলসম্যান অন্য কাউন্টারে সেবা দিলে সে নতুন হ্যান্ডগ্লাভস, নতুন অ্যাপ্রোন ব্যবহার করে। কিন্তু স্বপ্নে এসবের কোনো বালাই নেই। প্রতিষ্ঠানটির আউটলেটের কর্মীদের এসব নিয়ম-নীতি সম্পর্কে কোনো জ্ঞানও নেই।
সরেজমিনে রাজধানীর বনশ্রী, গুলশান ও বনানীতে স্বপ্নের কয়েকটি আউটলেটে দেখা যায়, মাছ ও মাংস বিক্রিতে ভিন্ন ভিন্ন চপিং বোর্ড ও হ্যান্ডগ্লোভস ব্যবহার না করেই যে হ্যান্ডগ্লাভসে মাছ ধরছে সেই একই হ্যান্ডগ্লাভসে মাংস ধরে প্যাকিং করছে, কখনো আবার ওজন করছে, যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এসব বিষয় নিয়ে বিরক্তও হচ্ছেন অনেক গ্রাহক। আবার সচেতনতার অভাবে অনেক গ্রাহক এসব সঠিক পদ্ধতি বোঝেনও না।
আরও দেখা যায়, ক্রেতার সামনেই গরুর হাড্ডি কাটছে। তা মেঝেতে পড়ছে, আবার মেঝে থেকে উঠিয়ে মাংসের সঙ্গে রাখছেন। এতে মাংস ও হাড়ের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। কম টাকায় কর্মী নিয়োগ দিয়ে বেশি মুনাফা করার লক্ষ্যে স্বপ্ন সঠিক কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। অনেকে বলেন, কর্মীদের প্রশিক্ষিত করারও ব্যবস্থা নেই।
কয়েকজন গ্রাহক অভিযোগ প্রকাশ করে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী মাছ, মাংস বা অন্য কোনো সবজি বা অন্য কোনো পণ্য ওজন করতে বা ধরতে হলে ভিন্ন ভিন্ন সেলসম্যান ও ভিন্ন ভিন্ন সরঞ্জাম থাকে। মাছ ধরার জন্য আলাদা হ্যান্ডগ্লাভস থাকে, মাংস ধরার জন্য আলাদা হ্যান্ডগ্লাভস থাকে। একইভাবে মাছ ও মাংস কাটার জন্য আলাদা চপিং বোর্ড থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের সুপার শপগুলোতে এসব ম্যানটেইন করা হয় না। অনেক সময় অভিযোগ করেও ফল পাওয়া যায় না। এসব বিষয়ে ম্যানেজমেন্টের নজরদারি বাড়ানো উচিত।’
রাজধানীর বনশ্রীতে স্বপ্নের সুপার শপে বাজার করতে আসা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আহম্মেদ জুয়েল শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সময় স্বল্পতার কারণে স্বপ্নে বাজার করতে এসেছি। তবে এখানে কিছু সিস্টেম ভালো লাগছে না। তিন ধরনের মাছ, মুরগি ও গরুর মাংস নিয়েছি। পরিতাপের বিষয় হচ্ছেÑএখানে একই সেলস ম্যান একই হ্যান্ডগ্লাভস পরে একই চপিং বোর্ডে মাছ, মাংস দুটোই কাটছে এবং সবগুলো জিনিস একই হ্যান্ডগ্লাভসে ধরছে। যদিও আমি বলার পর উনি (বিক্রয়কর্মী) হ্যান্ডগ্লাভস চেঞ্জ করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি নিষেধ করার পর উনি আমার কথা শুনেছেন। কিন্তু বিষয়গুলো আমার বলার কথা নয়। অনেক গ্রাহক নিজেই জানেন না তাদের সুরক্ষার বিষয়গুলো। সুতরাং এভাবে একই হ্যান্ডগ্লাভস পরে সব পণ্য স্পর্শ করছে। বিষয়গুলো নিয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো দরকার। তাহলে কভিড-১৯ থেকে আমরা কী শিক্ষা নিলাম? সুপারশপে ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম আরও বেশি কেয়ারফুল হওয়া দরকার, সচেতন হওয়া দরকার।’
বনানী আউটলেটের নিয়মিত গ্রাহক এম জামান বলেন, ‘স্বপ্ন গুণগত মানের চেয়ে মুনাফাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে তারা ন্যূনতম কোয়ালিটি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। গুলশান-বনানী এলাকার ক্রেতারা সাধারণত অনলাইনে অর্ডার দিয়ে থাকেন। স্বপ্নের প্রতি আস্থা রেখেই তারা এটি করেন। কিন্তু স্বপ্ন যে আস্থার মূল্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রায়ই তারা নি¤œমানের পণ্যসামগ্রী
সরবরাহ করে। অভিযোগ করলে তা বদলে দেয় ঠিক, কিন্তু অভিযোগ না করলে কেউ জানতেও পারে না। আসলে দেশের সাধারণ জনতা কোয়ালিটির ব্যাপারে মোটেও সচেতন নয়। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে যায় বলে বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ সাধারণ মানুষ ঠকিয়ে মুনাফা লুটে যাচ্ছে। এটা জাতির জন্য বড় দুর্ভাগ্য।’
কয়েকজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের জানান, ‘উন্নত দেশে সুপার শপগুলোতে মাছ, মাংসের একেক স্টলে বিক্রয়কর্মী ভিন্ন। কোনো পণ্য হাতে স্পর্শ করার জন্য আলাদা গ্লাভস ব্যবহার করা হয়। এগুলো না মেনে মাছ কাটার চপিং বক্সে মাংস কাটলে অনেক সময় নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া থেকে যায়। যেগুলো মানবস্বাস্থ্যের জন্য অনেক সময় ক্ষতিকর। এখন আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে। একটু কিছু হলেই মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে।’
জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘একই চপিং বোর্ডে মাছ ও মাংস কাটা হলে সেখানে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকে। কেননা মাছের অর্গানিজম এক রকম, মাংসের অর্গানিজম আরেক রকম। একই ভাবে মাছ ও মাংস ধরার জন্য ভিন্ন হ্যান্ডগ্লাভস ব্যবহার না হলে সেখানে ব্যাকটেরিয়া বংশ বিস্তার করতে পারে, যা স্বাস্থ্যকর নয়।’ জানতে চাইলে স্বপ্নের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাব্বির হাসান নাসির শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা প্রদানে স্বপ্ন দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা গ্রাহকদের যেকোনো অভিযোগ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সমাধান করে থাকি। গ্রাহকদের আরও বেশি সেবা প্রদানে আমরা বিষয়গুলো নোটিস করছি।’
