সৎ ব্যবসায়ীর ভালো প্রতিষ্ঠান খুঁজছে এনবিআর

নিজস্ব প্রতিবেদক: সৎ ব্যবসায়ীর ভালো প্রতিষ্ঠান খুঁজছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বিশেষ করে যে প্রতিষ্ঠান আমদানি-রপ্তানিতে স্বচ্ছ, রাজস্ব ফাঁকিতে কোনো দুর্নাম নেই এমন প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে আমদানি-রপ্তানিতে সর্বোচ্চ সুবিধা দিচ্ছে এনবিআর। অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর (এইও) সনদ দেয়ার মাধ্যমে এই সুবিধা দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে তিনটি ওষুধ কোম্পানি এই সুবিধা পাচ্ছে। তবে এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মতো আরও কিছু প্রতিষ্ঠানকে সনদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী আবেদনের জন্য সহসা বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, তিনটি প্রতিষ্ঠানকে তিন বছর আগে সনদ দেয়া হয়েছে। তিনটি প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও রাজস্ব আহরণে গতি আসবে।

এনবিআর সূত্রমতে, এইও’র সাময়িক স্বীকৃতি সনদের বিতরণের বিষয়ে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক। কমিশনার বলেন, বর্তমানে এইও-ভুক্ত তিনটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে এইও’র তালিকাভুক্ত করার মাধ্যমে সৎ ও যোগ্য ব্যবসায়ীদের এই সেবা নেয়ার সংখ্যা বাড়ানো হবে। ২০১৯ সালে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে এইও’র সাময়িক সনদ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নিজস্ব সফটওয়্যার স্থাপনের শর্ত দিয়ে বিভিন্ন কাস্টম হাউসকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এইও-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তিনটি আমদানি পর্যায়ে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা, তা পাচ্ছে না। তিনটি প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক প্রতিবেদন এরই মধ্যে এনবিআরে পাঠানো হয়েছে।

কাস্টমস মূল্যায়ন ভ্যাট সফটওয়্যারের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা করেনি। দু-একটি রিটার্ন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রেয়াত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে। বেক্সিমকো, স্কয়ার ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস ভ্যাট সফটওয়্যার স্থাপন করেছে বলে সভায় বলা হয়েছে। সভায় কমিশনার এইও’র সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আবেদন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। সভায় বলা হয়, ‘অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর (স্বীকৃতি দেয়া) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্তির বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। কিন্তু তালিকাভুক্তির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীর কাছে প্রচারের জন্য কমিটি কর্তৃক পত্রিকায় প্রকাশের সুপারিশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তির খসড়া অনুমোদনের জন্য এনবিআরে পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে এইও তালিকাভুক্তির অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠানের সাতটি যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑপ্রতিষ্ঠান ধারাবাহিকভাবে দেশে ন্যূনতম পাঁচ বছর ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর আইন প্রতিপালনে সুনাম থাকতে হবে। তিন বছর অপরাধ না করার প্রমাণ থাকতে হবে। রাজস্ব বকেয়া থাকতে পারবে না। কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর-সংক্রান্ত মামলায় জরিমানার পরিমাণ এক শতাংশের বেশি হতে পারবে না। প্রতিষ্ঠানের মূলধন ১৫ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন পাঁচ কোটি টাকা হতে হবে। আমদানিকারক হলে তিন বছরে গড় আমদানি পাঁচ কোটি টাকা ও রপ্তানিকারক হলে গড় রপ্তানি পাঁচ কোটি টাকা হতে হবে।

এইও সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ৯টি সুবিধা পাবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কাস্টম হাউস বা স্টেশনের পরিবর্তে এইও’র নিজস্ব আঙিনায় আমদানি করা পণ্য কায়িক পরীক্ষা করা হবে। পণ্য সরাসরি খালাস বা জাহাজীকরণ করা হবে। দ্রুত সেবাদানের জন্য কাস্টমস কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ টিম থাকবে। পণ্য চালান বন্দরে আসার আগে বিল অব এন্ট্রি অথবা বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল ও শুল্কায়ন সম্পন্ন করার সুযোগ। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে শুল্কায়ন সম্পন্ন করা। কাস্টম হাউসের সঙ্গে ই-মেইলে বা অনলাইনে যোগাযোগের সুযোগ। কাস্টমস স্টেশনে প্রবেশ ও কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকে বিশেষ পরিচয়পত্র দেয়া। স্বল্পতম সময়ে প্রত্যর্পণ প্রদান ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা অন্য কোনো মাধ্যমে চলমান মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা।

সূত্রমতে, বিশ্বের ৬৭টি দেশ আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজীকরণে এইও প্রক্রিয়া চালু করেছে। এর মধ্যে ১৪টি দেশ কাজ শুরু করেছে। ১৩টি দেশ প্রক্রিয়াধীন, যার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকেই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করে।

অন্যদিকে এনবিআরের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পণ্য খালাস করতে গড়ে ১১ দিন ৯ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট ও রপ্তানি প্রক্রিয়ায় জাহাজীকরণে সময় লাগে চার দিন ২২ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট। তবে এইও চালু হলে পণ্য খালাসে সময় লাগবে মাত্র ৩৮ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট বা এক দিন ১২ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট।

ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অরগানাইজেশনের (ডব্লিউসিও) সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে একজন আমদানিকারককে যে ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়, সেই একই ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে অন্য দেশে বন্দরের পণ্য খালাস করতে মাত্র ৬২ ঘণ্টা ২৪ মিনিট বা দুই দিন ১৪ ঘণ্টা ২৪ মিনিট সময় লাগে। সাধারণত নন-অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর (এইও) প্রতিষ্ঠান এভাবে পণ্য খালাস করে থাকে। এইও’র ক্ষেত্রে পণ্য খালাসে সময় লাগে মাত্র ৩৮ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট বা এক দিন ১২ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট।

এনবিআর সূত্র জানায়, ২০১২ সালে এনবিআর প্রথম এইও ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেয়। ২০১৮ সালের ২৮ জুন বিধিমালা জারি করে। ডব্লিউসিও’র শর্ত হিসেবে এই ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। বিধিমালা জারির পর থেকে এ সুবিধা দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠান খোঁজা শুরু করে এনবিআর। ওষুধ খাতের প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি অনেকটা স্বচ্ছ হওয়ায় প্রাথমিকভাবে ওষুধ খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করা হয়। পরে তিনটি প্রতিষ্ঠান শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটে আবেদন করে। যাচাই শেষে ২০১৯ সালে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে এ সনদ দেয়া হয়।

এনবিআর সূত্র জানায়, এ সনদের ফলে তিনটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম, মোংলা বা যেকোনো বন্দরে আমদানি সুবিধা পাচ্ছে। শুধু নিজ দেশেই নয়, যে দেশে রপ্তানি পণ্য যাবে, সে দেশেও একই ধরনের সুবিধা পাচ্ছে। তবে যেসব দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি রয়েছে, সেসব দেশে সুবিধা পাচ্ছে। এইও নিয়ে এখন পর্যন্ত বিশ্বে ১০০টির বেশি মিউচুয়াল রিকগনিশন এগ্রিমেন্ট (এমআরএ) রয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশের মধ্যে এসব সমঝোতা চুক্তি হয়েছে।

সূত্রমতে, ২০০৫ সালে পণ্যের নির্বিঘœ চলাচলে সেফ ফ্রেমওয়ার্ক চালু করে ডব্লিউসিও। সেখানে এইও ব্যবস্থা চালুর বিধান রাখা হয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে বাণিজ্য সহায়তা চুক্তি (ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন এগ্রিমেন্ট) হয়। এতে বাংলাদেশ সই করে। এই চুক্তির ৭ দশমিক ৭ অনুচ্ছেদে এইও ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়। ২০১২ সালে ভারত এই ব্যবস্থা চালু করে। ভারতের শতাধিক প্রতিষ্ঠান এই সনদ নিয়েছে। শিল্প উৎপাদক, আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ওয়্যারহাউস ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স এবং সমুদ্র, স্থল ও বিমানবন্দর এই এইও সনদ নিতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচন বিমানবন্দরও এ সনদ নিয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০