বিসমিল্লাহ গ্রুপের বোঝা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে প্রাইম ব্যাংক

জয়নাল আবেদিন: বিসমিল্লাহ গ্রুপের অর্থ আত্মসাৎ গত এক দশকে বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির মধ্যে একটি। এ গ্রুপেরই অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বিসমিল্লাহ টাওয়েলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ দেয়ার এক যুগ পার হয়ে গেলেও ফেরত আসেনি সে টাকা। সুদে আসলে ওই ঋণের পরিমাণ এখন ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ টাকা ফেরত পেতে আদালতের বারান্দায় চক্কর খাচ্ছে প্রাইম ব্যাংক। মামলাটি এখন ঢাকা অর্থঋণ আদালতে চলমান।

প্রায় এক যুগ আগে ঋণপত্রের বিপরীতে বিসমিল্লাহ টাওয়েলস লিমিটেডকে ১৩৩ কোটি ৫৭ লাখ ৪৯ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা ঋণ দেয় প্রাইম ব্যাংক। যে ঋণের পুরাটাই আত্মসাৎ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। নির্ধারিত সময় পর নন-ফান্ডেড ঋণটি ফান্ডেড ঋণের পরিণত হয়। এরপর ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তা পরিশোধের কোনো আগ্রহ দেখায়নি বিসমিল্লাহ টাওয়েলস।

ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করা হলেও এতে সাড়া দেয়নি তারা। পরে ২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে প্রাইম ব্যাংক। কিন্তু এতেও টনক নড়েনি প্রতিষ্ঠানটির। মামলার পরও ব্যাংকের কোনো অর্থ পরিশোধ করেনি বিসমিল্লাহ গ্রæপ। এমনকি মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য কোনো ধরনের আপিলও করেনি প্রতিষ্ঠানটি।

বিসমিল্লাহ টাওয়েলস লিমিটেড ১৩৩ কোটি ৫৭ লাখ ৪৯ হাজার ৪৫৯ কোটি ঋণ নিলেও তার সুদ ও সার্ভিসসহ এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০৯ কোটি ১৮ লাখ ৮৯ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। জানা গেছে, এ গ্রæপকে ঋণ দেয়ার সময় প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন এহসান খসরু। বিসমিল্লাহ কাণ্ডে এহসান খসরুকে ১১ জুন ২০১৩ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কারণ প্রাইম ব্যাংকের এমডি হিসেবে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে যোগ দিয়েছিলেন মো. এহসান খসরু।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এহসান খসরু শেয়ার বিজকে জানান, আমি প্রাইম ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগদান করার আগেই বিসমিল্লাহ গ্রæপকে ঋণটি দেয়া হয়েছিল। এই ঘটানার সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বরং এই দুর্নীতিটা আমিই প্রথম চিহ্নিত করেছিলাম। বন্ধ করেছিলাম বিসমিল্লাহ গ্রুপের অনিয়ম।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে ভুয়া জামানতে ১১৭৪ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ এনে বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী, তার স্ত্রী এবং গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরিন হাসিব এবং ব্যাংক কর্মকর্তাসহ মোট ৫৩ ব্যক্তির বিরুদ্ধে চার্জশিটের সুপারিশ করে প্রতিবেদন তৈরি করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত টিম। ৫৩ জনের মধ্যে বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১৩ জন রয়েছে। সঙ্গে ছিলেন প্রাইম ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাংটির ডিএমডি মো. ইয়াছিন আলী, মতিঝিল শাখার দুই সাবেক ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) মো. মোজাম্মেল হোসেন ও খোন্দকার ইকবাল হোসেন, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসভিপি) ও ফরেন এক্সচেঞ্জের ইনচার্জ ইব্রাহিম হোসেন গাজী, ২ অ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এভিপি) এ বি এম শাহ জাহান ও কাজী খাইরুল ইসলাম, ৩ সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার মোহাম্মদ ইকবাল আজিম কাদরী, মো. আবুল কালাম এবং এ কে এম জান-ই আলম।

দুদকের তথ্যমতে, ২০১২ ও ২০১৩ সালে বিসমিল্লাহ গ্রুপ ৫টি ব্যাংক থেকে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে। পরে ভুয়া এলসির মাধ্যমে পুরো অর্থই বিদেশে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। যেসব ব্যাংক থেকে গ্রুপটি ঋণ নিয়েছে সেগুলো হচ্ছে জনতা, প্রাইম, প্রিমিয়ার, যমুনা এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। এসব ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন বিসমিল্লাহ গ্রæপের এমডি-চেয়ারম্যানসহ গ্রুপের অন্যান্য কর্মকর্তা ও গ্রæপের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছে।

জানা গেছে, বিসমিল্লাহ গ্রুপের এমডি খাজা সোলায়মান ও চেয়ারম্যান নওরিন হাবিবসহ গ্রুপের কিছু কর্মকর্তা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে এমডি ও চেয়ারম্যান এখন দুবাইয়ে আছেন। ওখানে তারা একটি অভিজাত হোটেলের ব্যবসা করছেন।

২০১৯ সালে পাঁচটি ব্যাংকের কাছে নতুন করে ঋণ চায় বিতর্কিত বিসমিল্লাহ গ্রুপ। এ ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে অর্জিত মুনাফা থেকে ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করার প্রস্তাব দেয়া হয়। তবে সংশ্লিষ্টা জানান, গ্রুপটির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে। এখন আদালতই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে। আদালতের নির্দেশ ছাড়া এই গ্রুপকে ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই।

প্রসঙ্গত, কারখানার জন্য বিদেশ থেকে মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামাল আনেন শিল্পোদ্যোক্তারা। এ জন্য ব্যাংক তাদের ঋণপত্র সুবিধা দেয়, যা নন-ফান্ডেড ঋণ নামে পরিচিত। নগদ টাকার পরিবর্তে অন্য যেসব সুবিধা মিলে, তার সবই নন-ফান্ডেড। তবে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণপত্র, গ্যারান্টিসহ বিভিন্ন নামে নেয়া নন-ফান্ডেড ঋণ নির্দিষ্ট মেয়াদে শোধ করছেন না অনেকে। ফলে এসব ঋণ ফান্ডেড বা নগদ দায়ে পরিণত হচ্ছে। এরপরও শোধ না করায় এ ঋণগুলো ধীরে ধীরে খেলাপি হয়ে পড়ছে। তাতে এসব ব্যাংকের জন্য নন-ফান্ডেড দায় এখন বড় যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাইম ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ২০১১ সালের মার্চ পর্যন্ত এ গ্রাহকের সঙ্গে আমাদের লেনদেন খুবই ভালো ছিল। কিন্তু এর পরই তারা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ঋণপত্রের বিপরিতে যে নন-ফান্ডেড ঋণ তৈরি হয়েছিল সেগুলো এখন ফান্ডেড ঋণে পরিণত হয়েছে। কারণ নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হলে এগুলোকে ফান্ডেড ঋণে রূপান্তর করার বিধান রয়েছে। নানাভাবে চেষ্টা করেও ঋণটি আদায় না হওয়ায় ২০১৩ সালে আমরা অর্থঋণ আদালতে মামলা করি। এখনও ঢাকা অর্থঋণ আদালতে মামলাটি চলমান।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০