ডা. তাসনুভা আহমেদ খান: খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার দেশের সব নাগরিকের কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবনযাপনের প্রয়োজনে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে মিল রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের অবসান (এসডিজি-১), ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান (এসডিজি -২) অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা (২০১৬-২০২৫)- র সঙ্গে জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ-২০২২ প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ২৩ থেকে ২৯ এপ্রিল সারাদেশে জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ হিসেবে পালিত হচ্ছে। এ বছরের ‘প্রতিপাদ্য সঠিক পুষ্টিতে সুস্থ জীবন’।
প্রথমেই জানা দরকার অপুষ্টি কী? অপুষ্টি হলো ম্যাক্রো অথবা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সেবনে ঘাটতি, নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় গ্রহণ বা ভারসাম্যহীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি অবস্থা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পুষ্টি স্বল্পতা ও স্থ‚লতা এ দুটোই অপুষ্টির ধরন। শিশু খর্বকায় বা শীর্ণকায় হওয়াÑএ দুটোই পুষ্টি স্বল্পতার নির্দেশক। অপুষ্টির সঙ্গে আরও কতগুলো বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়, যেমনÑক্ষুধা, পরিমিত খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা ও তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা। খাবার থেকে পর্যাপ্ত শক্তি না পাওয়ার কারণে সৃষ্ট একটি অস্বস্তিকর বা বেদনাদায়ক অনুভ‚তি। খাদ্য বঞ্চনা, পর্যাপ্ত ক্যালোরি গ্রহণ না করা। দীর্ঘস্থায়ী পুষ্টি স্বল্পতার সঙ্গে আন্তঃবিনিময়যোগ্যভাবে এখানে ব্যবহƒত হয়। পুষ্টি স্বল্পতার প্রাদুর্ভাব (পিওইউ) দ্বারা পরিমাপ করা হয়। পরিমিত খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা হলো খাদ্য প্রাপ্তির সক্ষমতা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা, খাবার থেকে বাদ পড়ার বা খাবার শেষ হতে দেখার ঝুঁকি, পুষ্টিগত মান অথবা খাদ্য গ্রহণের পরিমাণের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য করা। তীব খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা হলো খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়া, ক্ষুধা অনুভব করা, একেবারে চরম অবস্থায় কোনো কোনো খাবার না খেয়েই এক বা একাধিক দিন পার করা।
সর্বস্তরের মানুষের কাছে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার মৌলিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া এবং জনগণের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা সরকারের মৌলিক উদ্দেশ্য। অন্যান্য সেবা খাতের মতো স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রেও নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। শিশুকাল থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত একজন নারী পুষ্টি ও প্রজননসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক ও আইনগত সমস্যার সম্মুখীন হন। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে জেন্ডার ইক্যুয়িটি স্ট্র্যাটেজি ২০০১, প্রণয়ন করা হয়েছে। জেন্ডার ইক্যুয়িটি স্ট্র্যাটেজি ২০০১ বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে জেন্ডার ইক্যুয়িটি স্ট্র্যাটেজি ২০১৪ তৈরি করা হয়েছে। জেন্ডার ইক্যুয়িটি স্ট্র্যাটেজির মূল লক্ষ্য হলোÑ‘নারী, শিশু, বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরী, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত এবং ভৌগোলিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও দারিদ্র্যদের জন্য প্রদত্ত সেবাগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন সাধন করা।’ জেন্ডার ইক্যুয়িটি স্ট্র্যাটেজি-২০১৪ এর বাস্তবায়ন কাল হচ্ছে ২০১৪-২০২৪। এ কৌশলের কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শেষে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সমাজের সব স্তরে স্বাস্থ্য ও সুস্থতার গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হিসেবে লিঙ্গ বৈষম্য বিদ্যমান। দীর্ঘায়ু সত্তে¡ও সাধারণ পুরুষের তুলনায় নারীরা স্বাস্থ্যকর সময় কম পেয়ে থাকে। নারীর এরূপ দুর্বল স্বাস্থ্য পরবর্তীতে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতায় পরিণত হয়। এটাও স্বীকৃত যে নারী ও মেয়েদের লিঙ্গ সমতা ও ক্ষমতায়ন ব্যক্তি, পরিবার, সংগঠন, সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। সরকারের মূল লক্ষ্য হলো একটি সুস্থ জাতি তৈরি করা, যাতে প্রত্যেক নাগরিকই জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে এবং দারিদ্র্যমোচনে সক্ষম হয়। দারিদ্র্যমোচন ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য একটি শক্তিশালী এবং কার্যকর স্বাস্থ্য খাতের বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা প্রদান এবং জনগণের প্রত্যাশিত সেবার পরিধি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, নার্সিং সেবা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সুবিধাসহ জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন, মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন ও বিতরণ এবং আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ, সেবাসংক্রান্ত স্থাপনা নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণ, শিশু ও মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি এবং পুষ্টি উন্নয়নে কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধি এবং নতুন আবিভর্‚ত রোগ নিয়ন্ত্রণ।
সরকার মা ও শিশুর জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিম অব্যাহত রাখা ও এর আওতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রসব-পূর্বসেবা, জরুরি প্রসূতিসেবা ও প্রসবোত্তরকালীন কার্যক্রম সম্প্রসারণসহ মিডওয়াইফারী এবং কমিউনিটিভিত্তিক দক্ষ ধাত্রী সেবা অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এছাড়া গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে আয়রন ট্যাবলেট এবং শিশুদের মধ্যে ভিটামিন-এ ক্যাপসুল ও কৃমিনাশক বড়ি বিতরণ এবং মাতৃদুগ্ধ পানে উৎসাহ প্রদানের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে গর্ভবতী মহিলা, প্রসূতি ও শিশুদের সম্পূরক খাবার প্রদানের আওতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ নিয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতাবিধি, শিক্ষা এবং শিশু সুরক্ষা সম্পর্কিত ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করছে। এগুলো বিশ্বের কাছে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এসডিজির মূলনীতি হলো কেউ পিছিয়ে থাকবে না, তার আলোকে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যারা পিছিয়ে আছে তাদের চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার দেশের পুষ্টি-বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এসব পদক্ষেপের ফলে পরিবারের গড় আকার কমে ৪.৩-এ দাঁড়িয়েছে, গড় প্রজনন হার ২.৩, স্তন্যপান করা শিশুর সংখ্যা ৯৮.৫, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় শতভাগ শিশুর উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জš§নিবন্ধনের হার বেড়েছে। মাঝারি ধরনের ও মারাত্মক পর্যায়ের খর্বকায় শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে এসেছে। বছরে দুইবার ৬-৫৯ মাস বয়সি শিশুদের ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হচ্ছে। এতে রাতকানা রোগের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন সাধিত হয়েছে। প্রায় সব পরিবারের ক্ষেত্রেই খাবার পানির সংগ্রহের উৎসের উন্নতি হয়েছে। গ্রামীণ ও শহরের পরিবারগুলোর মধ্যে এক্ষেত্রে পার্থক্য খুব সামান্য। এর মধ্যে ৪৩ শতাংশের ও বেশি জনগোষ্ঠী এমন এলাকায় বসবাস করে যেখানে তাদের আবাসস্থলেই পানির উৎস রয়েছে। তবে অনেক জায়গায় কাক্সিক্ষত মাত্রায় উন্নতি হয়নি। সেসব জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সরকার সচেতনভাবে সেগুলো নিয়ে কাজ করছে।
মা ও শিশুর জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও অন্যান্য সেবা প্রদানকারীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় নারীরা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হয়। সরকার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যায় নারী চিকিৎসক ও অন্যান্য নারী সেবা প্রদানকারী পদায়নসহ চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো নারীবান্ধব করার ব্যবস্থা করছে এবং করছে। এ সমস্যা এক দিনেই সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে এটা একটি চলমান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে। আগের তুলনায় এখন চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো অনেক বেশি নারী ও শিশুবান্ধব।
বিশ্বায়নের এ যুগে প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সুস্থ ও সবল জনগোষ্ঠী তৈরি এবং তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল সে াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দারিদ্র্যমোচন করা বর্তমান সরকার অন্যতম এজেন্ডা। দেশে মানুষের পুষ্টি-বৈষম্য দূর করে একটি একটি সুস্থ জাতি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
পিআইডি নিবন্ধ