খোন্দকার মাহ্ফুজুল হক: গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের লেখায় জীবন পরিসরে এক স্বতন্ত্র পর্যায় হিসেবে কৈশোরকালের পরিচয় পাওয়া যায়। শৈশবকাল ও বয়ঃসন্ধিকালের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী এক বিকাশমূলক পর্যায় হচ্ছে কৈশোরকাল।
দ্রæত শারীরিক বর্ধনের সময় হলো কৈশোরকাল। দৈহিক আকৃতিগত পরিবর্তন, দৈহিক অনুপাতগত পরিবর্তন, প্রধান প্রধান যৌন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ও গৌণ বৈশিষ্ট্যের বিকাশ এ সময়ে হয়ে থাকে।
পিটুইটারি ও গোনাড গ্রন্থিগুলো এ সময়কালে সক্রিয় হয় এবং হরমোন নিঃসৃত হয়। ফলে স্বাস্থ্য, মনোভাব, আচরণ, দ্ব›দ্ব, অপূর্ণতা, নিরাপত্তাহীনতা ও আমিত্ববোধসহ আরও অনেকগুলো দিক এ সময়ে প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়কালের পরিবর্তন খুব দ্রæত গতিসম্পন্ন হয় এবং স্বাস্থ্য ও আচরণে লক্ষণীয় হয়।
দেহ সুস্থ ও সবল রাখার প্রক্রিয়াকে পুষ্টি বলে। পরিবেশ থেকে দেহ প্রয়োজনীয় খাদ্যবস্তু আহরণ করে খাদ্যবস্তুকে পরিপাক ও শোষণ, আত্তীকরণ দ্বারা দেহের শক্তির চাহিদা পূরণ, রোগ প্রতিরোধ, বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণ করাই হলো পুষ্টি।
শিশুর গর্ভকালীন অবস্থা, পরোক্ষভাবে মায়ের শরীরের পুষ্টি থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত পুষ্টি একজন মানুষের অনুভ‚ত চাহিদাকে পূরণ করে। শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো এবং স্নায়ুতন্ত্র ব্যবস্থাকে সচল ও সবল রাখে। অঙ্গগুলোর সুষ্ঠুভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে মানবদেহের বর্ধন, শক্তি উৎপাদন এবং রোগ প্রতিরোধে প্রধান ভ‚মিকা পালন করে।
পৃথিবীতে সব প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য সুষম খাদ্য অপরিহার্য, অর্থাৎ যেখানে পুষ্টি প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের একটা সমন্বয়পূর্ণ ভারসাম্য বর্তমান থাকবে। প্রোটিন, শর্করা, স্নেহ পদার্থ, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও পানি এ ছয়টি উপাদান নিয়মিত খাদ্য তালিকায় থাকলে তা পুষ্টির কাজকে ত্বরান্বিত ও সুষম করে।
বয়সভেদে পুষ্টির চাহিদা ভিন্নরকম হয়ে থাকে। কৈশোরকালীন ক্যালরি, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রণসহ বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন হয়। কেননা, এ বয়সে শারীরিক ও মানবিক বিকাশ, বৃদ্ধি, পড়ালেখায় মনোনিবেশ, খেলাধুলা ও শরীরচর্চাসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা থাকে।
প্রতিদিন কিশোরীদের ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ২০০ ক্যালরি এবং কিশোরদের ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ ক্যালরি তাদের শক্তি সরবরাহ, উচ্চতা বৃদ্ধি ও ওজন ঠিক রাখতে প্রয়োজন হয়। পর্যাপ্ত ক্যালরিসহ অন্যান্য উপাদান গ্রহণ করলে দেহের গঠন ও বৃদ্ধি সাধিত হয়। এছাড়া শরীরের তাপশক্তি উৎপাদন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন, হাত ও দাঁতের স্বাভাবিক গঠন ও বিকাশ সাধন, চোখ সুস্থ ও দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখা, হƒদ-পেশীয় সংকোচন ও সম্প্রসারণ, রক্তের কোষ ভালো রাখা, দেহের ক্ষয়পূরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতিতে পুষ্টির ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে।
পুষ্টির অভাবে শরীরিক দুর্বলতা, অনিয়মিত হƒদকম্পন, ক্ষুধা অনুভব, বমিবমি ভাব, শুষ্ক ও খসখসে ত্বক, চর্মরোগ, দৈহিক সৌন্দর্যহানি, হƒদরোগ, উজ্জ্বল আলোতে চোখ জ্বালা, রাতকানা রোগ, নিস্তেজ কর্ণিয়া, চোখ শুকিয়ে অন্ধত্বজনিত সমস্যা, দেহে কোষের গঠন, ব্যাহত রক্ষণাবেক্ষণ ও জীবনীশক্তি, হরমোনজনিত সমস্যা, অস্বাভাবিক স্নায়ু ব্যবস্থা ইত্যাদি নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়। আবার অতিরিক্ত পুষ্টি গ্রহণের ফলে স্বাভাবিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, অতিরিক্ত মোটা হওয়া ইত্যাদি নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়।
বর্তমানে কিছু কিছু কিশোর-কিশোরী নিজেদের ফিট রাখার প্রবণতায় পর্যাপ্ত খাবার খায় না বা দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকে। একে ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’ বলা হয়। এতে করে তাদের রক্তস্বল্পতা, হাড় দুর্বলতা ও প্রজনন স্বাস্থ্যের সমস্যা তৈরি হতে পারে। কখনোবা কিশোর-কিশোরীদের স্মার্টফোন ব্যবহার করতে করতে বা টেলিভিশন দেখতে দেখতে খাবার খেতে দেখা যায়। এতে পেট ভরলেও তা শরীরের জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলে না। তাই মাইন্ডফুল খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।
আমাদের দেশের প্রায় ৩৩ শতাংশ কিশোরী অপুষ্টি ও রক্তশূন্যতায় ভুগছে। এ থেকে রক্ষা পেতে পর্যাপ্ত আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাই কিশোরীদের নিয়মিত ডিম, কলিজা, মাংস, পাতাযুক্ত সবজি, খেজুর, কিশমিশ, বেদানা, আনার, সফেদা, বিভিন্ন রকমের ফল, সবুজ শাকসবজি, কচুশাক, লালশাক, পালংশাক, ডাল খেতে হবে। এগুলো শরীরে শোষিত হওয়ার জন্য ভিটামিন সি জাতীয় খাবার লেবু, আমলকী, কাঁচা মরিচ, কমলালেবু, যেকোনো টক ফল ইত্যাদি খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন রাখতে হবে।
সুষম খাবার মানেই দামি খাবার নয়। অল্প খরচেও আমরা সুষম খাবার পেতে পারি। ভাত আমাদের দেশের প্রধান খাবার। এটি শর্করার প্রধান উৎস। প্রোটিন হিসেবে প্রতিদিন মাছ মাংস জোগাড় করতে না পারলেও সমস্যা নেই। ডাল, ছোলা, বাদাম, শিমের বিচি, সয়াবিন, গমের রুটি, যব, ইত্যাদিতে প্রচুর প্রোটিন রয়েছে, যা সস্তা এবং সহজলভ্য। শস্য দানার সঙ্গে ডাল বা ডালজাতীয় মিশ্রণ যদি খাদ্য তালিকায়, থাকে তাহলে তা মাছ মাংসের সমান প্রোটিন দিতে সক্ষম।
সজিনা, মুলা, ধনেপাতা, পালংশাক, লাউশাক, ডঁটাশাক, পুঁইশাক, মিষ্টিকুমড়া, কলমিশাক, লালশাক এগুলোতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি, বিটা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, আঁশ ইত্যাদি। এছাড়া মৌসুমি সহজলভ্য ফল জাম্বুরা, আমড়া, জাম, কামরাঙা, আনারস, লিচু, তরমুজ, পাকা কলা, কাঁঠাল, আম ইত্যাদি এবং সবজি উচ্ছে, করলা, ফুলকপি, ওলকপি, সজিনা, টমেটো, ক্যাপসিকাম, পেঁয়াজকলি, কলার মোচা, শালগম, বীট, কাঁচা কাঁঠাল, ঢ্যাঁড়স, পটোল, আলু প্রভৃতি ভিটামিন-সিসহ অন্যান্য ভিটামিনের চমৎকার উৎস। সূর্যের আলো ভিটামিন ডি-এর সেরা উৎস। লটকন, চালতা, করমচা, লুকলুকি, উড়িআম, বৈঁচি, চামফল, নোয়াল, রক্তগোটা, মাখনা, আমঝুম, মুড়মুড়ি, তিনকরা, কুল, বাউকুল, কাজী পেয়ারা, বাউ-৫ পেয়ারা, থাই পেয়ারা, সাতকরা, তৈকর, আদা জামির, ডেফল, কাউফল, বনলেবু, চালতা ইত্যাদি আমাদের গ্রামাঞ্চলে সহজলভ্য। এগুলো ফলিক এসিডসহ অন্যান্য ভিটামিনের সহজ উৎস। মটরশুঁটি, বরবটি, লেটুস, গাজর, কচুশাক, সরিষা শাক, ব্রকলি, মিষ্টিআলুসহ অন্যান্য সবজি ও ফল আমাদের দেশের সব অঞ্চলেই পাওয়া যায়। তাই এগুলোর মাধ্যমে আমাদের গ্রামাঞ্চল, হাওরাঞ্চল এবং শহরের বস্তিবাসী খুব সহজেই পুষ্টিশূন্যতা পূরণ করতে পারে।
পুষ্টির পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলা প্রয়োজন। সকালে খাবার বাদ না দেয়া, ফ্যাট ডায়েট অনুসরণ না করা, ফাস্ট ফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার না খাওয়া, মিষ্টিজাতীয় খাবার সীমিত করা, পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা, নিজেকে শারীরিকভাবে ফিট দেখতে অন্যের সাথে তুলনা করার প্রবণতা পরিহার করা, শরীরচর্চামূলক ক্রিয়াকলাপে যুক্ত থাকা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশে খাদ্য পরিবেশন ও গ্রহণ করা, ভেজাল ও দূষণমুক্ত খাবার গ্রহণের প্রবণতা তৈরি ইত্যাদির অনুসরণ সুস্থ স্বাস্থ্য নিশ্চিতে ভ‚মিকা পালন করে, যা কৈশোরকালীন সুস্থ স্বাস্থ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ।
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশই কিশোর-কিশোরী, যার প্রায় অর্ধেক কিশোরী। কিশোর বয়স সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এ বয়সে পুষ্টি সচেতনতাই দিতে পারে সুস্বাস্থ্যের বার্তা। বলা হয়ে থাকে, মায়ের পুষ্টিই শিশুর তুষ্টি। আজকের কিশোরীরাই হলো আগামীর মা। সুস্থ ও স্বাস্থ্যবতী মা স্বাস্থ্যবান সন্তানের জš§ দিতে পারে। তাই কিশোরীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সচেতনতার বিষয়ে সবাইকে দায়িত্ববান হতে হবে।
‘সঠিক পুষ্টিতে সুষ্ঠু জীবন’ প্রতিপাদ্যে প্রতি বছরের মতো ২০২২ সালের ২৩-২৯ এপ্রিল পালিত হয়েছে জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ। এ উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে পুষ্টি সচেতনার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী ২৭ শতাংশ পুষ্টি ঘাটতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এ কর্মসূচির আওতায় পুষ্টি সপ্তাহে বিশেষ সেবা প্রদান, জেলা, উপজেলা ও বিভাগগুলোতে দুস্থদের মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্য বিতরণ, পুষ্টি সচেনতা বার্তা বিতরণ, মসজিদের খুতবা এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপসানালয়ে স্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষ বার্তা প্রদানসহ অন্যান্য কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর যৌথভাবে ‘কৈশোরকালীন’ পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরই আলোকে তারা ২৫টি জেলার ২৫০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাইলটিং কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়সহ সরকারের অন্যান্য বিভাগগুলো তাদের নিজ নিজ কার্যক্রমে এ বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। পাশাপাশি বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিয়োজিত রয়েছে। সরকার প্রত্যেক জেলায় ‘কৈশোরকালীন পুষ্টি’ সচেতনতাকল্পে প্রত্যেক জেলায় একজন কাউন্সিলরের পদ (রাজস্ব) সৃষ্টি এবং প্রত্যেক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুইজন শিক্ষককে পুষ্টি কার্যক্রম বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খাদ্যের সহজলভ্যতা ও পুষ্টিমূল্য বজায় রেখে খাদ্য গ্রহণই পারে পুষ্টির চাহিদা পূর্ণ করতে। পুষ্টির সচেতনতায় স্কুল হেল্থ প্রোগ্রাম বাড়ানো ও সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা বাড়ানোর পাশাপাশি সবাইকে নিজ নিজ স্থান থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পুষ্টিমান সমৃদ্ধ প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফল, সবজি ও দানাদার শস্য ও প্রাণিজ আমিষের পুষ্টিগুণ প্রচারে এবং তা গ্রহণে মানুষকে উৎসাহীকরণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশে দারিদ্র্য কমলে পুষ্টিহীনতা কমবে এবং নারীকে ক্ষমতায়িত করলে শিশুদের পুষ্টিহীনতায় ভোগার মাত্রা কমবে। কৈশোরকালীন পুষ্টির ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তনে সবার অংশগ্রহণ সময়ের দাবি। প্রয়োজন শুধু সচেতনতা এবং ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যায় পর্যন্ত সমন্বিত উদ্যোগ ও অপুষ্টি দূরীকরণে আন্তরিক প্রচেষ্টা।
পিআইডি নিবন্ধ