মেঘনার ভাঙন থেকে চাঁদপুরের হরিণা ফেরিঘাট এবং চরভৈরবি এলাকার কাটাখাল বাজার রক্ষা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষ দিকে। প্রকল্পের কাজে অনিয়ম আর গোঁজামিলের অভিযোগ উঠেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে এ-সংক্রান্ত নানা তথ্য উঠে এসেছে। এ নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব
মনির উদ্দিন ও বেলায়েত সুমন: পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁদপুর সার্কেলের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত ‘মেঘনা নদীর ভাঙন থেকে চাঁদপুর জেলার হরিণা ফেরিঘাট এবং চরভৈরবি এলাকার কাটাখাল বাজার রক্ষা প্রকল্পে’ নদীর রূপগত (মরফোলজিক্যাল) জটিলতার অজুহাতে শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী বরাদ্দকৃত ৯৮ কোটি টাকার সাত কিলোমিটার নদী ড্রেজিংয়ের কাজ।
সূত্র জানায়, এ প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১৯০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ৭৯০ মিটার মেঘনা নদীর বামতীর সংরক্ষণ, ১৩২ দশমিক ৫৮ মিটার অ্যান্ড টার্মিনেশন নির্মাণ এবং ৬১ দশমিক ২৫ লাখ ঘনমিটার (সাত কিলোমিটার) নদী ড্রেজিংয়ের সাতটি প্যাকেজের কাজ বাস্তবায়নের জন্য উন্মুক্ত ক্রয় পদ্ধতির (ওটিএম) পরিবর্তে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু প্রকল্পের অনুমোদিত ডিপিপিতে বর্ণিত সাতটি প্যাকেজের কাজ বাস্তবায়নের জন্য সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি (ডিপিএম) অনুসরণের জন্য সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক ক্রয়-সংক্রান্ত মন্¿িসভা কমিটি সুপারিশ করে।
অপরদিকে ২০১৮ সালের মে মাসে ড্রেজিংয়ের কাজের জন্য দরপত্র আহ্বানের বিজ্ঞাপন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের জুলাই মাসে দরপত্র গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পরে বাপাউবো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দরপত্রটি বাতিল করা হয়। এরপর আবার একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর নতুন দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র গ্রহণের পরে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং ঠিকাদাররা সাড়া না দেয়ায় বাপাউবো কর্তৃপক্ষ পুনঃদরপত্র আহ্বানের অনুমতি দেয়।
একই বছরের ডিসেম্বর মাসে দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং দরপত্র গ্রহণের জন্য ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে বলা হয়, নদী ড্রেজিং কাজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হলে প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব নয়। অতি দ্রুত নদী ড্রেজিং কাজের ঠিকাদার নির্বাচন করে নদী ড্রেজিং কাজ আরম্ভ করতে হবে, যদিও এরপর নদী ড্রেজিং কার্যক্রম আর আলোর মুখ দেখেনি।
পরে চরভৈরবি এলাকায় কার্যস্থলে নদীর মরফোলজিক্যাল পরিবর্তনজনিত কারণে নকশা রিভিউ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি নদী ড্রেজিং কাজের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে মতামত দেয় এবং পাশাপাশি ডিজাইন রিভিউ করার সিদ্ধান্ত দেয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাপাউবো সংশ্লিষ্ট ডিজাইন দপ্তর কর্তৃক রিভিউকৃত নকশা অনুসারে ১২০ মিটার টার্মিনেশনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করার কথা বলে।
২০১৯ সালের নভেম্বরে পানিসম্পদ মন্¿ণালয়ে অনুষ্ঠিত স্টিয়ারিং কমিটির দ্বিতীয় সভায় বোর্ড কর্তৃক গঠিত কারিগরি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ড্রেজিং কাজের সাশ্রয়কৃত অর্থ দিয়ে অ্যান্ড টার্মিনেশনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি হরিণা ফেরিঘাট এলাকায় বাস্তবায়নাধীন তীর সংরক্ষণ কাজের ভাটিতে নদীতীর সংরক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্তের আলোকে প্রণীত সংশোধিত ডিপিপির ওপর মন্¿ণালয়ের ২০২০ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত যাচাই সভায় নতুন প্রস্তাবিত ডিজাইন পুনর্নিরীক্ষণ ও মিটারপ্রতি ব্যয় হ্রাসের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এ সিদ্ধান্তের আলোকে হালনাগাদ নকশা উপাত্তের ভিত্তিতে নতুন প্রস্তাবিত কাজের নকশা সংশোধন করা হয়। সংশোধিত নকশা অনুযায়ী মিটারপ্রতি ব্যয় প্রায় ৩৫ ভাগ হ্রাস পায়।
পরে সংশোধিত নকশা অনুযায়ী, নদী ড্রেজিং কাজের সাশ্রয়কৃত অর্থ দিয়ে হরিণা ফেরিঘাট এলাকায় বাস্তবায়নাধীন তীর সংরক্ষণ কাজের ভাটিতে এক হাজার ৬০০ মিটার নদীতীর সংরক্ষণ প্রস্তাবিত সংশোধিত ডিপিপিতে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এছাড়া প্রকল্প চলাকালে বাস্তবায়নাধীন প্রতিরক্ষা কাজের নিকটবর্তী এলাকায় কোনো ডুবোচর চর সৃষ্টি হলে প্রকল্পের কাজের স্থায়িত্বের স্বার্থে তা অপসারণের জন্য আড়াই কোটি টাকার থোক সংস্থান রেখে ডিপিপি সংশোধনপূর্বক আবার দাখিল করা হয়। প্রস্তাবিত সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদনের পর কার্যাদেশ দেয়ার শর্তে বর্ণিত এক হাজার ৬০০ মিটার কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়।
দরপত্র অনুযায়ী, চারটি প্যাকেজের এক হাজার ৬০০ মিটার কাজ বর্তমানে চলমান থাকার কথা থাকলেও রয়েছে তিনটি প্যাকেজে এক হাজার ২০০ মিটার কাজ। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরের উন্নয়ন প্রকল্পভুক্ত বাস্তব কাজের অগ্রগতির প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
অপরদিকে নদী ড্রেজিংয়ের প্রস্তাবিত স্থান থেকে আগেই শত শত কোটি টাকার বালি উত্তোলন করে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে একটি প্রভাবশালী বালিদস্যু চক্রের বিরুদ্ধে। ফলে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। নদী থেকে অবৈধ ও অপরিকল্পিত উপায়ে বালি উত্তোলনের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নদীর রূপগত পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়ার নেপথ্যে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কতিপয় কর্তাব্যক্তি রয়েছেন বলেও অভিযোগ ওঠে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবো চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী রেফাত জামিল শেয়ার বিজকে বলেন, ভবিষ্যতে ডুবোচর সৃষ্টি হলে তা অপসারণের জন্য সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পে আড়াই কোটি টাকা রাখা হয়েছে।