ইসমাইল আলী: দেশের সর্ববৃহৎ দুই সেতু হলো পদ্মা ও বঙ্গবন্ধু সেতু। যমুনা নদীতে নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন করা হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন। এর ২৪ বছর পর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। আগামী ২৫ জুন সেতুটি উদ্বোধনের কথা রয়েছে। দৈর্ঘ্যরে দিক থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর তুলনায় এক দশমিক ২৮ গুণ বড় পদ্মা সেতু। দুটির সক্ষমতা, গুণাগুণ ও নির্মাণ বৈশিষ্ট্যেও রয়েছে ভিন্নতা।
এদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর তুলনায় পদ্মার নির্মাণব্যয় আটগুণেরও বেশি (৮০৫%)। তবে পদ্মা সেতুতে টোলের হার সে তুলনায় অনেক কম। যানবাহনভেদে পদ্মায় টোলের হার ধরা হয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতুর এক দশমিক ৩৬ থেকে দুই দশমিক ৭৫ গুণ। দুই সেতুর টোলের হার বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে।

সূত্র জানায়, গত বছর জুনে চূড়ান্ত করা হয়েছে পদ্মা সেতুর টোলের হার। একই সময় বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলের হার বাড়ানোর প্রস্তাবও অনুমোদন করা হয়, যদিও তা কার্যকর হয় নভেম্বরে। এ দুই টোলের হার বিশ্লেষণ করেছে শেয়ার বিজ। এতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু সেতুতে বাইকের টোল ৫০ টাকা। পদ্মা সেতুতে তা ধরা হয়েছে ১০০ টাকা। অর্থাৎ বাইকের টোলের হার দ্বিগুণ। আর দুই সেতুতে ব্যক্তিগত গাড়ি ও সাধারণ জিপের টোলের হার যথাক্রমে ৫৫০ টাকা ও ৭৫০ টাকা। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু সেতুর তুলনায় পদ্মায় এ বাহনের টোল মাত্র ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি।
এদিকে বিলাসবহুল জিপের (যেমন: স্টেশনওয়াগন, প্রাডো, নিশান ইত্যাদি) জন্য পদ্মা সেতুতে টোলের হার ধরা হয়েছে উচ্চ হারে। এ ধরনের জিপে বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল সাধারণ জিপের সমানই ৫৫০ টাকা। তবে পদ্মা সেতুতে এ টোলের হার এক হাজার ২০০ টাকা। আর বঙ্গবন্ধু সেতুতে পিকআপ ও মাইক্রোতে একই হারে (৬০০ টাকা) টোল আদায় করা হয়। তবে পদ্মা সেতুতে পিকআপে টোল এক হাজার ২০০ টাকা। তবে মাইক্রোর জন্য টোল গুনতে হবে এক হাজার ৩০০ টাকা।
অপরদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ৩১ আসন পর্যন্ত সব ধরনের বাসের (কোস্টার ও মাঝারি/মিনিবাস) টোলের হার সমান। এ বাসগুলোর সেতুটিতে টোল গুনতে হয় ৭৫০ টাকা। তবে পদ্মা সেতুতে কোস্টার তথা ছোট বাসের জন্য টোল দিতে হবে এক হাজার ৪০০ টাকা। আর মাঝারি/মিনিবাসের জন্য টোল দিতে হবে দুই হাজার টাকা। এছাড়া বড় বাস (৩২ আসন বা তার বেশি) পারাপারে পদ্মা সেতুতে টোল দিতে হবে দুই হাজার ৪০০ টাকা, যা বঙ্গবন্ধু সেতুতে এক হাজার টাকা।
পদ্মা সেতুতে যাত্রীবাহী বাসে টোলের হার কিছুটা বেশি হারে ধরা হলেও পণ্যবাহী ট্রাকের জন্য দেয়া হয়েছে অনেকটাই ছাড়। ফলে সেতু দুটিতে ট্রাকে টোলের হারে পার্থক্য তুলনামূলক অনেক কম। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ছোট ট্রাকে (৫ টন পর্যন্ত) টোল দিতে হয় এক হাজার টাকা, মাঝারি ট্রাকে (৫-৮ টন) এক হাজার ২৫০ টাকা ও বড় ট্রাকে (৮ টনের বেশি) এক হাজার ৬০০ টাকা। পদ্মা সেতুতে এ তিন ধরনের ট্রাকে টোল দিতে হবে যথাক্রমে এক হাজার ৬০০ টাকা, দুই হাজার ১০০ টাকা ও দুই হাজার ৮০০ টাকা।
যদিও তিন এক্সেলের ট্রাকে (কাভার্ড ভ্যান) পদ্মা সেতুতে টোলের হার ধরা হয়েছে তুলনামূলক বেশি হারে। এ ধরনের ট্রাক পারাপারে পদ্মা সেতুতে টোল গুনতে হবে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা। বঙ্গবন্ধু সেতুতে এ ট্রাকে টোলের হার দুই হাজার টাকা। অর্থাৎ এ ট্রাকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পৌনে তিনগুণ টোল দিতে হবে পদ্মা সেতুতে।
এর বাইরে চার এক্সেলের ট্রেইলারে বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল গুনতে হয় তিন হাজার টাকা, পদ্মা সেতুতে যা ছয় হাজার টাকা। আর চার এক্সেলের বেশি ট্রেইলারের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল গুনতে হয় চার এক্সেল পর্যন্ত তিন হাজার টাকা ও পরবর্তী প্রতি এক্সেলে এক হাজার টাকা। পদ্মা সেতুতে এ ধরনের ট্রেইলারে টোলের হার ধরা হয়েছে চার এক্সেল পর্যন্ত ছয় হাজার টাকা ও পরবর্তী প্রতি এক্সেলে এক হাজার ৫০০ টাকা।
দুই সেতুর নির্মাণব্যয় ও টোলের হারের তুলনা প্রসঙ্গে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু সেতু দুটি ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন অঞ্চলে, ভিন্ন নদীপ্রকৃতিতে ও ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে নির্মাণ করা হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই দুই সেতুর মধ্যে তুলনা চলে না। ফলে দুই সেতুর নির্মাণব্যয় ও টোলের হারের মাঝেও তুলনা করা উচিত নয়। তবে স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বঙ্গবন্ধু সেতুর তুলনায় পদ্মা সেতুর টোলের হার কমই মনে হবে।
সূত্র জানায়, সেতু বিভাগের আওতাধীন সেতু, উড়াল সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও টানেলের টোল হার নির্ধারণ বা পুনর্নির্ধারণে ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি বঙ্গবন্ধু সেতুর বর্ধিত টোল হার ও পদ্মা সেতুর টোল হার নির্ধারণ করে। পদ্মা সেতুর টোল হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ফেরি পারাপারের চার্জের দেড়গুণ হিসাব করে কমিটি। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল হারও বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ তা অনুমোদন করে।
টোল নির্ধারণ কমিটির এক সদস্যা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রাথমিকভাবে ফেরির চার্জের দেড়গুণ তথা ১৫০ শতাংশ হারে পদ্মা সেতুর টোল নির্ধারণের বিষয়টি নিয়ে কাজ করা হয়। তবে সরাসরি দেড়গুণ করতে গেলে ভাঙতির টাকার ঝামেলা এসে পড়বে। তাই রাউন্ড ফিগার হিসেবে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই কিছু ক্ষেত্রে ১৫০ শতাংশের চেয়ে কম বা বেশি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর ঋণ পরিশোধ ও মূল্যস্ফীতি এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা করে প্রতি তিন বছর পরপর টোল হার পুনর্নির্ধারণের সুপারিশ করেছিল কমিটি। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় তা বাতিল করেছে। মূলত মানুষের সক্ষমতার বিষয়টির কথা মাথায় রেখে তা বাতিল করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে প্রতিবার টোল বৃদ্ধির আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে।
সেতু বিভাগের যুগ্ম সচিব রাহিমা আক্তার বলেন, পদ্মা সেতুর টোলহার নিয়ে একটা প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য চলতি মাসে সারসংক্ষেপ পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে অনুমোদন করায় খসড়া যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কমানোর সম্ভাবনা কম। প্রধানমন্ত্রী এ হারই অনুমোদন দেবেন বলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন।