জয়নাল আবেদিন: অস্থিরতা বিরাজ করছে দেশের ডলার মার্কেটে। ব্যাংকের কারসাজির মাধ্যমেই এ অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি নয় কেউ। আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
রপ্তানি কম ও আমদানি বেশি হওয়ার দোহাই দিয়ে ডলারের দাম বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো। বৈদেশিক এই মুদ্রা হাতে রেখেই কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রপ্তানিকারকদের। তারা বলছেন, অল্প দামে ডলার কিনে ধরে রেখেছেন। এখন সেই ডলার বিক্রি করে অধিক মুনাফা নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দামে ডলার বিক্রি করছে না কোনো ব্যাংকই। কারণ কিনতে হচ্ছে বেশি দামে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দামেই ডলার বিক্রি করেছে। কিছু ব্যাংকের বিরুদ্ধে বেশি দাম নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে সেই বেশির পরিমাণ খুবই কম। তিনি আরও জানান, যদি কোনো ব্যাংক আসলেই কারসারিজর মাধ্যমে ডলারের দর বৃদ্ধি করে থাকে, তাহলে তদন্তের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গতকাল রাজধানীর ব্যাংকপাড়া মতিঝিল, পল্টন ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক্সচেঞ্জ (মুদ্রা বিনিময়) হাউসগুলোয় খুচরা ডলার ১০০ টাকা থেকে ১০২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক দিন আগেও এ দর ছিল ৯৬ থেকে ৯৮ টাকা।
গতকাল মঙ্গলবার বিকালে পাইওনিয়ার এক্সচেঞ্জ হাউসে ডলারের দাম জানতে চাইলে দায়িত্বরত কর্মী বলেন, আজ রেট ১০২ টাকা। তবে এখন নিতে চাইলে এক টাকা কম রাখা যাবে। এর নিচে দেয়া যাবে না। এত দাম কেনÑজানতে চাইলে তিনি বলেন, গতকাল (সোমবার) ৯৭-৯৮ টাকায় বিক্রি করেছি, আজ ১০২ টাকা উঠেছে, কাল আরও বাড়বে। কারণ ডলার পাচ্ছি না; চাহিদা আছে, ডলার নেই।
মতিঝিলের আরেক ডলার ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার বলেন, ১০১ টাকা ৫০ পয়সা দরে বিক্রি করছি। মানুষ বিদেশ যাচ্ছে। এখন নগদ ডলারের প্রচুর চাহিদা। ব্যাংকগুলোতেই ডলারের সংকট। এখন প্রতিদিনই দুই-তিন টাকা করে দাম বাড়ছে। সামনে হজ মৌসুম আসছে, আরও দাম বাড়বে।
গুলশানের মেট্রো মানি এক্সচেঞ্জের স্বত্বাধিকারী শাহজাহান মিয়া বলেন, সকালে ১০২ টাকায় বিক্রি হয়েছে ডলার। সর্বশেষ বিকাল ৫টায় দর ছিল ১০১ টাকা ৩০ পয়সা। আমরা গ্রাহকের কাছ থেকে ১০০ টাকা ৫০ পয়সায় ডলার কিনছি। পুরো বাজারে ডলারের চাহিদা বেশি। আমরা কম কম আনতে পারছি, তাই হঠাৎ দাম বেড়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ গত সোমবার ডলারের দর বেঁধে দিয়েছে ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু তাদের বেঁধে দেয়া এ রেট বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মানছে না। এখন ব্যাংকে এলসি করতে গেলে ডলারের বিপরীতে নেয়া হচ্ছে ৯২ থেকে ৯৩ টাকা। আবার কোনো কোনো ব্যাংক ৯৫/৯৬ টাকাও নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে ব্যাপকহারে আমদানির চাপ বেড়েছে। ফলে আমদানির দায় পরিশোধে বাড়তি ডলার লাগছে। কিন্তু সেই তুলনায় রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়েনি। ফলে ব্যাংক-ব্যবস্থা ও খোলা বাজারে মার্কিন ডলারের ওপর চাপ বাড়ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে ঘাটতি দেখা দি?য়ে?ছে, যার কারণে টাকার বিপরীতে বাড়ছে ডলারের দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কিন্তু তারপরও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না ডলার।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের জুলাই থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এর পর থেকে বড় ধরনের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সংকট শুরু হয়, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে।
২০২১ সালের ৩ আগস্ট থেকে দু-এক পয়সা করে বাড়তে বাড়তে গত বছরের ২২ আগস্ট প্রথমবারের মতো ৮৫ টাকা ছাড়ায় ডলারের দাম। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি এটি বেড়ে ৮৬ টাকা হয়। গত ২৩ মার্চ আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় দাঁড়ায়। ২৭ এপ্রিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা, ১০ মে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা এবং গত সোমবার ৮৭ টাকা ৫০ পয়সায় দাঁড়ায় ডলারের মূল্য, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। অর্থাৎ গত ৯ মাসের ব্যবধানে প্রতি ডলারে দর বেড়েছে দুই টাকা ৭০ পয়সা।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১২ মে পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৫০২ কোটি (৫.০২ বিলিয়ন) ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত অর্থবছরে ডলার কেনায় রেকর্ড গড়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সবমিলিয়ে প্রায় আট বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কেনে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পাঁচ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে আমদানির চাপে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের (রিজার্ভ) ওপর চাপ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ আগের সব রেকর্ড ভেঙে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। দেশের ওই রিজার্ভ গত ১১ মে ৪১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন বা চার হাজার ১৯৩ কোটিতে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে রপ্তানি বেড়েছে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আলোচিত ৯ মাসে রপ্তানি থেকে দেশ আয় করেছে তিন হাজার ৬৬২ কোটি ডলার। পণ্য আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ছয় হাজার ১৫২ কোটি ডলার। আমদানি ব্যয় থেকে রপ্তানি আয় বাদ দিলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় দুই হাজার ৪৯০ কোটি ডলার।
জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে এক হাজার ৫৭৮ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে, যা ছিল আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম।