মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ

মো. মাঈন উদ্দীন: দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসাবাণিজ্য কভিড মহামারির ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মানুষের আয় কমেছে, অনেক মানুষ বেকার হয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে অসংখ্য মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশের ২২ থেকে ২৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। কভিডের কারণে সেটি বেড়েছে। কোনো সমীক্ষায় ৪২ শতাংশ আবার কেউ কেউ বলেছে ৪৫ শতাংশ। তার মানে প্রায় ৩ কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। করোনার আগে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, করোনার মধ্যে তাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছিল। কভিড যখনই কমে আসছিল, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে তখন নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি মানুষকে আবারও সংকটে মধ্যে পতিত করে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে। বর্তমানে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির চাপটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য মূল্যস্ফীতি হয়তো বিরক্তিকর বিষয় কিন্তু গ্রাম ও শহর এলাকায় দরিদ্র মানুষের জন্য মূল্যস্ফীতি জীবিকার সংকট তৈরি করছে। পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেছেন, দেশের মানুষের মাথা পিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ২৩৩ ডলার। চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) বাজেট ঘোষণার সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। সরকার বলছে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। মূলত প্রবৃদ্ধির হার বা মাথা পিছু আয়ের হিসাব দিয়ে প্রান্তিক মানুষের জীবনমান পরিস্থিতি বোঝা যায় না। বিবিএস বলেছে, চলতি অর্থবছরে শিল্প, সেবা ও কৃষিÑএ তিন খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সবচেয়ে বেশি ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এ দিকে ব্যবসায়ীরা দাবি করছে করোনার পর থেকে তাদের ব্যবসাবাণিজ্য ভালো নেই। অন্যদিকে ব্যাংকাররা বলছেন, দেশের আর্থিক খাতের ৯০ শতাংশ অর্থায়ন গেছে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। কভিডকালে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে যে ঋণ দেয়া হয় তার ৯০ শতাংশ দেয় ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন, সুদ, ভর্তুকি পাচ্ছে ব্যাংকগুলো কিন্তু দিন শেষে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি বেড়েছে। কম সুদে যে ঋণ দেয়া হয়েছে তার ৩০-৪০ শতাংশ এখন ফেরত আসছে না। এদিকে করোনার পর পর প্রচুর পণ্য আমদানি হয়েছে। আমদানি ঝুড়িতে নতুন নতুন পণ্য যুক্ত হচ্ছে। ২০২২ সালে করোনার প্রভাব কমলে বৈশ্বিকভাবে পুঞ্জীভ‚ত চাহিদাও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অনেকের খরচের ধরন পাল্টে গেছে। কভিডের পর বহু মানুষ দুবাই, থাইল্যান্ডসহ বিদেশ ভ্রমণে গেছে। বিদেশে ঘুরতে যাওয়া বেড়েছে। তবে এ প্রবণতা শুধু আমাদের দেশে নয় দুনিয়া জুড়েই হচ্ছে। প্রবাসী আয়ও কমে যাচ্ছে। এতে সংকট তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব তো আছেই। ডলারের দাম ৯৫-৯৭ টাকায় অতিক্রম করছে। বেশি দামে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। মূল্যস্থিতি বেড়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতিতে শুধু গরিব মানুষের নিত্যপণ্য নয়, শিল্প খাতের ও কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি খরচ বাড়ছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানির ওপর শুল্ক-মার্জিনসহ কিছু বিধি আরোপ করলেও ডলারের সংকট কাটাতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশ, (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সঙ্গে আলোচনা করে প্রতি ডলারের দাম কত হবে তা নির্ধারণ করে দেয়। ব্যাংকারদের মতে, এতে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যসূত্রে বলা হয়েছে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মাচ) সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৬৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ সময় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ঘাটতি বেড়েছে। রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩২.৯২ শতাংশ। আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এতে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংকট উত্তোলনের জন্য সঠিক ব্যবস্থাপত্র তৈরি করতে হবে। আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান-ব্যাংক-বীমা, পুঁজিবাজার, রাজস্ব খাত ও স্থানীয় সরকারকে অর্থনীতির নানাবিধ ঝুঁকি মোকাবিলায় মনোযোগী হতে হবে।

বিবিএস তথ্য থেকে দেখা গেছে, সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি খুব বিস্তৃত, পণ্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি হচ্ছে। বিবিএস প্রাক্বলন হলো ভোক্তা ব্যয় ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এখন মোট জিডিপির ৭৮ শতাংশ ভোক্তাব্যয়। যেখানে আগে ছিল ৬৮ শতাংশের কাছাকাছি। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ভোক্তাব্যয় বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে কিছুটা প্রশমন করতে হবে। এই ক্ষেত্রে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনীতিবিদদের মতে মূল্যস্ফীতিকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মূল স্তম্ভ হিসেবে দেখতে হবে। সিপিডির বিশেষ ফেলো, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় গরিব মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার কথা চিন্তা করলে বাজেট ঘাটতি বড় বিষয় নয়। এই শ্রেণির মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ অর্থ সহায়তা ও খাদ্য সহায়তায় ব্যবস্থা রাখা দরকার। তাদের সুরক্ষা প্রতিষেধক হলো টিসিবির কার্যক্রম বিস্তৃত করা, খাদ্য মূল্য কমানো।

বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার চেয়ে স্বল্প মেয়াদে পরিস্থিতির সমাধানে মনোযোগী হওয়া উচিত। ডলারের চাহিদা বৃদ্ধিকে কীভাবে কমানো যায় এবং জোগান কীভাবে বাড়ানো যায়, সেটা বের করতে হবে। ঋণ প্রদানে সুদহার বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতির স্বাভাবিক স্তর ৫ শতাংশের নিচে না আনা পর্যন্ত গ্রাম ও শহরের দরিদ্র মানুষদের নগদ সহায়তাসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দিতে হবে। ঝুঁকি মোকাবিলার বড় হাতিয়ার হলো যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা। রিজার্ভকে সুরক্ষা রাখার জন্য কিছু অতিরিক্ত ব্যবস্থা নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে নগদ সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি ভাবা উচিত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভর্তুকি বাড়াতে গেলে বাজেট বাড়াতে হবে। ভর্তুকি কমাতে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। পেট্রলের জন্য সরকার অনেক টাকা ভর্তুকি দিয়ে, একই ভাবে গরিব মানুষের খাদ্য উৎপাদনের জন্য মূল্যকর ভর্তুকিও দেয়া উচিত। তবে ভর্তুকি কিছুটা দিতেই হবে। প্রয়োজনে বাজেটে অন্য জায়গা থেকে সাশ্রয় করতে হবে। জনগণের দৈনন্দিন জীবন সহজ ও পণ্যমূল্য সাধ্যের মধ্যে রাখতে আমরা প্রয়োজনে শ্রীলঙ্কার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিতে পারি। শ্রীলঙ্কার অপরিকল্পিত মেগা প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প চলমান। প্রকল্পের ঋণ শোধে যে আর্থিক চাপ সেটি সামাল দেয়ার জন্য আমাদের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। পরিকল্পনা করে বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এগোতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি ও সারের মূল্য বেড়ে গেছে। ব্যাহত হচ্ছে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী মন্দার সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান ডেভিট ম্যালপাস। এক্ষেত্রে আমাদের মতো দেশের খাদ্য কৃষি উৎপাদনে মনোযোগী হতে হবে। খাদ্য উৎপাদন, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য বিপণনের পথে বাধা দূর করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কৃষি ও কৃষি সরঞ্জাম, কীটনাশক ও সারের সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। দেশে প্রয়োজনীয় সারের ৮০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি হয়। এর মধ্যে এমওপি সারের বড় অংশ আসে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা যায় ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি, এমওপিÑএ চার ধরনের সার ব্যবহার হয় ৫৭ লাখ টন।  চলতি অর্থবছরে ৬৯ লাখ টন সার ব্যবহার হয়। আগামী অর্থ বছরে (২২-২৩) এর চার ধরনের সারের চাহিদা কমিয়ে ৫৫ লাখ ৫০ হাজার টনে আনা হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়, সারের কারণে যাতে নতুন করে ফসল উৎপাদনে সমস্যা না হয়; সে দিকে নজর দেয়া উচিত। বিনিয়োগ ও সক্ষমতার কথা বলতে গেলে বলতে হয় ব্যবসায়ে ব্যয় ও দক্ষতার দিক থেকে ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। অদক্ষতার জন্য আমাদের দেশে ব্যবসায় খরচ (কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস) অনেক বেশি, করহার, বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট খরচ, অবকাঠামো, ইনফরমাল পেমেন্টস ইত্যাদি অনেক বেশি। তাছাড়া জ্বালানি তেলের কাঁচামাল ও শ্রমের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টিও রয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। শ্রমের মজুরিও বাড়াতে হচ্ছে। বিনিয়োগ সক্ষমতাও তেমন এগোনো যাচ্ছে না। নিত্যপণ্য চাল, ডাল, তেল, সবজি, মাছ, মাংসসহ এমনকি পাউরুটি, সাবান, আটা-ময়দা, গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট, চানাচুর, টয়লেট ক্লিনারসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন খবরের কাগজে চোখ যেতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির খবর আগে পড়তে হয়। সেদিন ঢাকার কাওরান বাজারের এক দোকানদার বললেন, পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে কাস্টমারের মুখের দিকে চাইতে কষ্ট লাগে। মূল্যস্ফীতির এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকেই দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আসন্ন বাজেটে তার প্রতিফলন থাকা উচিত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মাথাপিছু সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা বৃদ্ধির কথা কেউ কেউ বলেছে, তা প্রয়োজন, তবে তা স্থায়ী সমাধান নয়। কার্ডের মাধ্যমে সহায়তা দেয়া প্রশংসনীয় হলেও এটা সাময়িক। আমাদের আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এক সময় বড় উদ্যোক্তায় পরিণত হয়। ব্যবসা বাড়ানো, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা বলা হলেও দেখা যায় কাগজপত্রের জটিলতা উদ্যোক্তা তৈরি হওয়া ব্যাহত হয়। বাস্তবতা হচ্ছে দেশে ব্যবসা কাঠামো, অবকাঠামো, পরিবেশ তৈরি না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্য হবে নিন্মবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষকে ক্রয় ক্ষমতাকে সুরক্ষা দেয়া, ব্যয় ও আয় উভয় ক্ষেত্রেই সুরক্ষা দেয়া উচিত। প্রবৃদ্ধির চেয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রিন্সিপাল অফিসার

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড

main706@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০