জয়নাল আবেদিন: কোনোভাবে থামানো যাচ্ছে না খেলাপি ঋণের লাগাম। করোনাকালীন সুবিধা উঠে যাওয়ায় এক লাফে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি ৮৬ লাখ টাকায় পৌঁছেছে দেশের ঋণখেলাপি। হিসাব অনুযায়ী এই ঋণখেলাপির হার মোট ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকায়। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। তিন মাস আগেও ২০২১ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। আর গত বছর মার্চের তুলনায় খেলাপি বেড়েছে ১৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। এর আগে ২০২১ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০২০ সালে কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে তাকে খেলাপি করা হয়নি। ফলে আদায় তলানিতে নামলেও খেলাপি ঋণ কম ছিল। ২০২১ সালে বিশেষ সুবিধার ছাড় কিছুটা কমিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নির্দেশনার বলা হয়, গত ডিসেম্বরের শেষ কর্মদিবসের মধ্যে ঋণের ১৫ শতাংশ পরিশোধ করেই খেলাপি হবে না গ্রাহক। পরে মৌখিকভাবে এ ছাড় আরও ২০ দিন বাড়ানো হয়। এরপর খেলাপি ঋণ গিয়ে ঠেকে এক লাখ তিন হাজার ২৩ কোটি টাকায়। এখন এসব সুবিধা তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তারপরও গ্রাহণ ঋণ পরিশোধ করছে না, বিশেষ করে বড় ঋণগ্রহীতারা, যে কারণে হু-হু করে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
খেলাপিদের নানা রকম ছাড় দেয়ার কারণে তারা এখন ঋণ পরিশোধ করছে না বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়ার পেছনে মূল কারণ আমাদের দেশে খেলাপিদের ঋণ শোধ না করার বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হয়; সুদ কমানো হয়, মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হয়। এসব সুবিধা পেয়ে তারা আর ঋণ শোধ করে না। তারা মনে করে খেলাপি হলেও বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। এ কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর যারা সুবিধা নিয়ে ঋণ নিয়মিত করে রেখেছে, তাদের হিসাব যোগ করলে খেলাপির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। খেলাপি ঋণ ব্যাংকের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এতে করে পরিচালন ব্যয় অতিমাত্রায় বেড়ে যায়।
কীভাবে কমানো সম্ভবÑজানতে চাইলে সাবেক এ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, টাকা নিলাম ফেরত দিলাম না, আমার কোনো শাস্তিও হলো না। তাহলে ফেরত দেব কেন? কোনো গ্রাহক যদি জানে, সে খেলাপি হলে তিরস্কার নয় পুরস্কার পাবে, তাহলে তো সে খেলাপি হবেই। তাই একটাই সমাধানÑশাস্তি। যত দ্রæত সম্ভব খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে যতই নির্দেশনা দেয়া হোক কাজ হবে না।
এদিকে ঋণ পরিশোধের বিশেষ সুবিধা আরও এক বছর বাড়াতে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। বৈঠকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কথা বিবেচনায় নিয়ে চলতি বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের বিশেষ সুবিধা চাওয়া হয়। বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা হবে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের মার্চ শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে দুই লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৪৮ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো আলোচিত সময় ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৫৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৬৩ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা বিতরণ করা ঋণের মধ্যে দুই হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা খেলাপি, যা মোট প্রদান করা ঋণের ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। আলোচিত সময়ে বিশেষায়িত তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হয়েছে চার হাজার ১৫ কোটি টাকা। এ অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ০১ শতাংশ। তারা বিতরণ করেছে মোট ৩৩ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা।