সাইদ সবুজ, চট্টগ্রাম: বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উদ্দেশ্যে সরকার ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক সহায়তা হিসেবে বন্ড সুবিধা দিয়েছে। যার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা স্থানীয় অথবা বিদেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করছে। কিন্তু এ সুবিদার অপব্যবহার করে অনেক ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি করছেন। যার বিপরীতে সরকার বৃহৎ অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। তবে বিভিন্ন সময় নানাভাবে রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা সামনে এলে এবার বন্ড সুবিধায় তৈরিকৃত বাণিজ্যিক পণ্য আমদানির বিষয়টি সামনে এসেছে; যা আবার অবৈধ অপসারণের পাশাপাশি সরাসরি রপ্তানি হচ্ছে। সম্প্রতি সিইপিজেডের প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স কন্ডা আর্ট মেটেরিয়ালস বাংলাদেশে কোম্পানি লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি ওসব পণ্য অবৈধ অপসারণের চেষ্টাও করে। তবে অবৈধ অপসারণকালে প্রতিষ্ঠানটির ১০টি কাভার্ডভ্যান হাতেনাতে আটক করে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট। পরে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা পরিদর্শন করলে সত্যতা পাওয়া যায়। ফলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দুটি কারণ দর্শানো নোটিসের বিপরীতে এক কোটি ৬২ লাখ ৪৭ হাজার ৮৪১ টাকার রাজস্ব আদায়ের দাবি তোলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনার সূত্রে জানা যায়, আর্ট মেটেরিয়াল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটের সিইপিজেড ডিভিশনে মেসার্স কন্ডা আর্ট মেটেরিয়ালস বাংলাদেশে কোম্পানি লিমিটেড নিবন্ধিত। সম্প্রতি বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে অসত্য ঘোষণায় কাঁচামালের পরিবর্তে তৈরিকৃত বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি করে তা আবার সরাসরি রপ্তানি করছে এমন সংবাদ পায় চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট। ফলে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটের সদর দপ্তর থেকে একটি টিম গত ১৩ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটি আকস্মিক পরিদর্শনে যায়। এ সময় পরিদর্শনকারী দল প্রতিষ্ঠানটির মূল ইউনিটি এবং ইউনিট-২-এর ইন্টু বন্ড, এক্স বন্ড ওয়্যারহাউস এবং প্রোডাকশন ফ্লোর সরেজমিন পরিদর্শন করে গোপন সংবাদের সত্যতা পায়। ফলে ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ইনভেন্টি সম্পন্ন করে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা। এ সময় দেখা যায়, এক লাখ তিন হাজার ৮৬২টি ফেব্রিক টোট ব্যাগ, ৮৩ হাজার ১৬টি মেটালিক হ্যালোইন ট্রিট ব্যাগ এবং চার হাজার ৩২০টি পলিয়েস্টার লাঞ্চ ব্যাগ পাওয়া যায়; যা তৈরির জন্য ওই প্রতিষ্ঠানেরর কোনো মেশিনাজির নেই। এ সময় প্রতিষ্ঠানের উপস্থিত কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা কোনো উত্তর দিতে পারেননি। ফলে প্রাপ্ত ফিনিশড পণ্যগুলোর ইন্টু-বন্ড ওয়্যারহাউসে রাখার বিপরীতে প্রামাণিক দলিলাদি সরবরাহ করতে বলা হলেও তারা কোনো ধরনের প্রামাণিক দলিলপত্র দেখাতে পারেনি। পরে অধিকতর যাচাইয়ের জন্য পণ্যের বর্ণনা মোতাবেক কাস্টম সিস্টেম অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম হতে ইমপোর্ট জেনারেল ম্যানিফেস্ট (আইজিএম) বেপজার অটোমেশন সিস্টেম হতে প্রতিষ্ঠানটি আইপি যাচাই করেও উপরোক্ত বর্ণনার পণ্য আমদানির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এতে প্রতীয়মান হয় প্রতিষ্ঠানটি বন্ডেড ওয়্যারহাউসে প্রাপ্ত ফিনিশড পণ্যগুলো অসত্য ঘোষণায় আমদানি করেছে। অর্থাৎ এক লাখ ৯১ হাজার ১৯৮টি পণ্যের বিপরীতে ৭৩ শতাংশ হারে ২৪ লাখ ৪৮ হাজার ৮৯৩ টাকা রাজস্ব ফাঁকি হয়।
অন্যদিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায়, গত ১২ এপ্রিল রাতে প্রতিষ্ঠানটি ইপিজেডের অভ্যন্তরে বিভিন্ন পয়েন্টে অবৈধ অপসারণের উদ্দেশ্যে ফিনিশড পণ্য বোঝাইকৃত ১০টি কাভার্ডভ্যান রেখেছে। তারপর ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটর সিইপিজেডে দায়িত্বরত দুজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার সিইপিজেডের বিভিন্ন পয়েন্টে কাভার্ডভ্যানগুলো শনাক্ত করে। এ সময় শনাক্তকৃত ১০টি কাভার্ডভ্যান সম্পর্কে ওই প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা অস্বীকার করে। পরে কাভার্ডভ্যানের গায়ে লিখিত শিপিং লাইনের মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, গাড়িগুলো মেসার্স কন্ডা আর্ট মেটেরিয়ালস বাংলাদেশে কোম্পানি লিমিটেডের পণ্য রপ্তানির জন্য সরবরাহ করা হয়েছে। তারপর চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেটের ১৫ সমস্যের একটি টিম মেসার্স কন্ডা আর্ট মেটেরিয়ালস বাংলাদেশে কোম্পানি লিমিটেড চত্বরে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে। এ সময় চারটি কাভার্ডভ্যানে এক লাখ পাঁচ হাজার ৩৩৬টি করে টিজেড হলোগ্রাফি টেক কেস, তিনটি কাভার্ডভ্যানে ৫৩ হাজার ৫৬৮টি করে ফেব্রিক টোট ব্যাগ, একটি কাভার্ডভ্যানে ৭৩ হাজার ৪৪০টি মেটালিক হ্যালোইন ট্রিট ব্যাগ এবং দুটি কাভার্ডভ্যানে ৫২ হাজার ২৬০টি করে পলিয়েস্টার লাঞ্চ ব্যাগ পাওয়া যায়। অর্থাৎ এসব পণ্য রপ্তানির জন্য প্রতিষ্ঠানটি ইপিজেকে থেকে বের করার চেষ্টা করছিল। যদিও এসব পণ্য ওই প্রতিষ্ঠানে উৎপাদনের জন্য কোনো মেশিনারিজ নেই। একই সঙ্গে এ ধরনের কোনো কাঁচামাল স্থানীয় অথবা আমদানির কোনো ক্রয় তালিকাও নেই। ফলে প্রাপ্ত তৈরিকৃত পণ্যের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানকে জিজ্ঞাসাবাধ করা হলে তারা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। অর্থাৎ এসব তৈরিকৃত পণ্য মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করে কাস্টম অনুমতি, বেপজার ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট পারমিট, গেট পাস, ইএক্সপি, বিল অব এন্ট্রি, ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট ইত্যাদি ছাড়া অবৈধভাবে গাড়িতে বোঝাই করে জোনের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল প্রতিষ্ঠানটি। যার বিপরীতে এক কোটি ৩৭ লাখ ৯৮ হাজার ৯৪৮ টাকা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনার একেএম মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি অসত্য ঘোষণার মাধ্যমে তৈরিকৃত পণ্য আমদানি করে তা আবার পুনরায় রপ্তানির অথবা অবৈধ অপসারণের মাধ্যমে বিভিন্ন ধারায় কাস্টমস আইন এবং বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালার বিধিগুলো সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে; যা কাস্টম আইন মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ ও লাইসেন্স বাতিলযোগ্য। ফলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দুটি কারণ দর্শানো নোটিস জারি করা হয়েছে।