কভিড মহামারি উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিকে প্রচণ্ড আঘাত করেছে। এরই মাঝে ডলারের চড়া দামের ফলে মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতির সামাল দিতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান দফায় দফায় কমাতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।
গত ১৫ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ডলারের আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ৯২ টাকা ৮৫ পয়সা, যা আগের দিন ছিল ৯২ টাকা ৮০ পয়সা। চলমান বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার ১৫তম অবমূল্যায়ন এটি। এদিকে আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার বেঁধে দেয়া হলেও খোলাবাজারে তার চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ডলার। কোনো কোনো সময় তো এই দাম ১০০ টাকাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ মৌল সুদের হার বাড়াচ্ছে। ফলে ট্রেজারি বন্ডের প্রিমিয়াম রিটার্ন লাভজনক হয়েছে এবং ডলার শক্তিশালী হয়েছে। ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে উদীয়মান অর্থনীতিগুলোয় ঋণপ্রাপ্তি মোটেও সহজলভ্য থাকবে না, যা ক্ষতিগ্রস্ত করবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের বাজারকে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি মূল্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির রেশ কাটতে না কাটতেই ডলারের চড়া মূল্য অর্থনীতিকে চরমভাবে আঘাত করেছে। আমদানি খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে গত অর্থবছরের তুলনায় ৪৬ দশমিক ২১ শতাংশ বেশি। সংকটে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বিদেশি মুদ্রার ব্যবসায়ীরা বলছেন, এশিয়ার মুদ্রা দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। কেবল বাংলাদেশেই নয়, পাকিস্তান, ভারত ও জাপানেও ডলারের দাম বাড়ছে উচ্চগতিতে। বিগত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে ডলারের দাম। যার ফলে স্বল্পমেয়াদে সুদের হারের মুনাফা পেতে যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজি স্থানান্তর করছেন অনেক বিনিয়োগকারী।
এদিকে নির্ধারিত দামে ডলার বেচাকেনা নিয়ে চাপে পড়েছে বেশিরভাগ ব্যাংক। রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে অনেক ক্ষেত্রেই নির্ধারিত দামে ডলার কিনতে পারছেন না তারা। ডলারের চড়া মানের কারণে আমদানি ও ঋণ পরিশোধের খরচ দুটোই বেড়েছে লক্ষণীয়ভাবে। তবে সেই তুলনায় রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়েনি। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কিন্তু তারপরও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না ডলার।
ডলারের বাড়তি মূল্য চলতি বছর উদীয়মান বাজারের মুদ্রা সূচক ৩.৫ শতাংশ কমিয়েছে। ডলার শক্তিশালী হলে আমদানিতে মূল্যস্ফীতি ঘটে। বর্তমান বিশ্ববাজারে খাদ্য ও তেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বিভিন্ন দেশেগুলোর মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ বিদেশে চলে যাচ্ছে উচ্চসুদের আশায়। বর্তমানে মানুষের বিদেশ ভ্রমণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে; যার ফলে নগদ ডলারের প্রচুর চাহিদা। যেখানে ব্যাংকগুলোতেই ডলারের সংকট।
সম্প্রতি নানা কারণে শ্রীলংকা কঠোর আর্থিক সংকটে পড়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতিও সমালোচনার মুখে পড়েছে। চলমান পরিস্থিতি সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। উদীয়মান বাজার অর্থনীতিতে সব সংকটই কোনো না কোনোভাবে ডলারের সঙ্গে সম্পর্কিত। মুদ্রাটির মান বাড়লে তাই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে মুদ্রানীতি কঠোর করতে হয়। সেটি না হলে মুদ্রাস্ফীতির ভয়াবহ পরিণতি কমবেশি সবগুলো দেশকে পোহাতে হয়।
রাফিহা বিনতে মিজান
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়