পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে উপকৃত হবেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীরা। ওই অঞ্চলে সম্প্রসারণ হবে বিনিয়োগ ও শিল্পোৎপাদন। কমবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। এতে সব মিলিয়ে ৩১ বছরে পদ্মা সেতু থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা মিলবে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতু শুধু সেতু নয় এটি একটি স্বপ্ন, একটি গৌরবের নাম। দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ অবকাঠামো। যে সেতুর জন্য বাঙালি জাতি অধীর আগ্রহ অপেক্ষা করেছে এক যুগেরও বেশি সময়। অবশেষে আজ খুলে যাচ্ছে সে স্বপ্নের দুয়ার। উম্মোচন হচ্ছে সম্ভাবনার দিগন্ত। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সাথে রাজধানীর সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হতে যাচ্ছে এ সেতু দিয়ে।
যদিও এ সেতু নির্মাণে এসেছে নানা বাধা, নানা জটিলতা। তবে সব বাধা পেরিয়ে সব জটিলতার অবসান ঘটিয়ে সেতুটি খুলে দিতে তৈরি আজ উদ্বোধনী মঞ্চ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল ১০টায় মাওয়া প্রান্তে সেতুটির উদ্বোধন করবেন। এর মাধ্যমে বাঙালি জাতির এক যুগেরও বেশি সময়ের অপেক্ষার অবসান হবে। স্বপ্ন আর সম্ভাবনার সীমানা মিলিত হবে এক বিন্দুতে। আর আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুটিতে যানবাহন চলাচল শুরু হবে আগামীকাল সকাল ছয়টা থেকে।
২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর বসানো হয় পদ্মা সেতুর শেষ (৪১তম) স্প্যান। এতে দৃশ্যমান হয় পুরো (৬.১৫ কিলোমিটার) সেতুর কাঠামো। তবে নির্মাণকাজের তখনো অনেকখানি বাকি ছিল। সব কাজ শেষে ২২ জুন সেতুটি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) কাছে হস্তান্তর করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (এমবিইসি)। তবে নানা জটিলতায় বারবার পিছিয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নির্মাণ করতে হয়েছে এ অবকাঠামোটি। এসব চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে চারটি বিষয় মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে আসে। এর প্রথমটি ছিল ভুল পরিকল্পনা তথা ভুল প্রকল্প গ্রহণ। ২০০৭ সালের ২৮ আগস্ট সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্প অনুমোদন করে। তবে সেটি ছিল শুধু সড়ক সেতু। ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ বঞ্চিত হওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছিল। যদিও সে সময় নির্মাণব্যয়ও ধরা হয়েছিল অনেক কম, মাত্র ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তবে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর তা সংশোধন করে রেলপথ যুক্ত করে পদ্মা সেতুতে।
পদ্মা সেতুর পরিকল্পনাটা অবশ্য শুরু ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে। যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ শেষেই পদ্মা সেতুর নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। সে সময় সেতুটি নির্মাণে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। তার ভিত্তিতে মাওয়া-জাজিরা রুটে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক পরিকল্পনা নেয়া হয়। আর সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ২০০১ সালের ৪ জুলাই। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়ায় এ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কথা দিয়েছিলেন পরবর্তী নির্বাচনে জিতে আবারও ক্ষমতায় গেলে পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু করবেন। তবে তা আর হয়নি।

সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় সেতুটি নির্মাণে চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ পরিচালনা করে জাইকা। এর ভিত্তিতে মাওয়া-জাজিরা রুটটি পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য চূড়ান্ত করা হয়। এরপর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অর্থায়ন সংগ্রহে বিভিন্ন দাতা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে চারদলীয় জোট সরকার। তবে অর্থায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না হওয়ায় প্রকল্পটি আর এগোয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়ে সেতু নির্মাণের কার্যক্রম পুনরায় চালু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের কাজ। এজন্য ২০০৮ সালের ১০ জুলাই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে চুক্তি সই হয়। এর আওতায় ১ কোটি ১১ লাখ ৭৯ হাজার এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস) বা প্রায় ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেয় সংস্থাটি। কঠিন শর্তের এ ঋণে সুদের হার ৬ শতাংশ। ২০ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।
পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব পায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক মনসেল-এইকম। যদিও পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে রেলপথ সংযুক্ত করায় নকশা প্রণয়ন প্রক্রিয়া সংশোধন করা হয়। এতে নকশা প্রণয়ন ব্যয়ও বেড়ে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ৩ মে এডিবির সঙ্গে আরও ৬২ লাখ ৭৪ হাজার এসডিআর বা প্রায় ৭০ কোটি টাকার আরেকটি ঋণ চুক্তি সই হয়। এ ঋণেও সুদহার ছিল ৬ শতাংশ। আর ২০ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
ওই নকশার ভিত্তিতে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় পুনরায় প্রাক্কলন করা হয়, যার ভিত্তিতে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় পদ্মা সেতু প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। এতে সেতুর নির্মাণব্যয়ও দ্বিগুণ হয়ে যায়। হিসাবের অঙ্কে তার পরিমাণ ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। তখন দুই তলা সেতু (নিচ তলায় রেল এবং ওপর তলায় সড়ক) নির্মাণের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। আর সে সময় পদ্মা সেতুর অর্থায়নে এগিয়ে আসে বিশ্বব্যাংক। সেই বছর পদ্মা সেতু নির্মাণে ২৮ এপ্রিল ১২০ কোটি ডলার ঋণ চুক্তি সই হয় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে।
বিশ্বব্যাংক ছাড়াও তিন উন্নয়ন সহযোগী পদ্মা সেতুতে ঋণ দিতে সম্মত হয়। এদের মধ্যে এডিবি ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার, জাইকা ৪০ কোটি ডলার ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ১৪ কোটি ডলারের ঋণ দিতে পর্যায়ক্রমে চুক্তি সই করে। এর মধ্যে আইডিবির ঋণের সুদহার ছিল কিছুটা বেশি। বাকি তিন সংস্থা (বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা) সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার কথা ছিল।
ঋণচুক্তির পাশাপাশি মূল সেতু, নদীশাসন, পরামর্শক, দুই পাড়ের (মাওয়া ও জাজিরা) সংযোগ সড়ক এবং সার্ভিস এলাকার জন্য পৃথক ছয়টি দরপত্র আহ্বান করা হয়। তবে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে পদ্মা সেতু তথা দেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ঘটে যায়। আর তা হলো পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক। মূলত পদ্মা সেতুর পরামর্শক হিসেবে কানাডার এসএনসি লাভালিনকে সর্বনিন্ম দরদাতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ অভিযোগ তোলা হয়। আর এ অযুহাতে প্রকল্পের দরপত্র ও অর্থায়ন স্থগিতের ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। এটি ছিল সেতুটি নির্মাণে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্বব্যাংকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অন্য তিন সংস্থাও ঋণ স্থগিত করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে। তবে এরপর বিশ্বব্যাংকের পেছনে সরকার অনেকটা হন্যে হয়েই ঘোরে। বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে কানাডার পাশাপাশি বাংলাদেশেও পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত শুরু করা হয়। এছাড়া বিশ্বব্যাংক নিজেও তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করে। তাদের শর্ত মেনে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ও সেতু বিভাগের সচিবকে বদলি করা হয়।
সৈয়দ আবুল হোসেন আইসিটি মন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেও তাতে আপত্তি তোলে বিশ্বব্যাংক। এতে বাধ্য হয়ে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পাশাপাশি দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। যদিও পরবর্তীতে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায়নি দুদক। বিশ্বব্যাংকও দুর্নীতির প্রমাণ দিতে ব্যর্থ। এমনকি ঘটনার মূল সূত্রপাত যে কানাডা থেকে সেখানেও মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।
এদিকে তদন্ত চলাকালীন পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন শুরু করার জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে কয়েক দফা আবেদন করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অর্থায়ন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বব্যাংক। এতে অনেকটা বিরক্ত হয়েই বিশ্বব্যাংককে না বলে দেয় বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। তবে এতে দুই বছর পিছিয়ে যায় প্রকল্পের কাজ। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে মূল সেতু নির্মাণে চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০১৩ সালের জুনে। তবে বিশ্বব্যাংকসহ চার দাতা সংস্থা না থাকায় চূড়ান্ত দরপত্রের জন্য যোগ্য বিবেচিত পাঁচ কোম্পানির মধ্যে চারটিই পিছিয়ে যায়। শুধু চায়না মেজর ব্রিজ পদ্মা সেতু নির্মাণে চূড়ান্ত দরপত্র জমা দেয়। যদিও এর মাঝে পদ্মা সেতু নির্মাণ ও অর্থায়নে আগ্রহ দেখায় মালয়েশিয়া সরকার। এ বিষয়ে আর্থিক প্রস্তাব দিলেও পদ্মা নদীর বিশালতা দেখে তারা আর কারিগরি প্রস্তাব জমা দেয়নি।
এদিকে একক দরদাতা হলেও সেতু বিভাগের প্রাক্কলনের চেয়ে কম দর প্রস্তাব করায় সেতু নির্মাণের কাজ পায় এমবিইসি। ২০১৪ সালের ১৭ জুন তাদের সঙ্গে চুক্তি সই হয়। আর নদী শাসনে তিনটি কোম্পানি দরপত্র জমা দিলেও সর্বনি¤œ দরদাতা হিসেবে কাজ পায় চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। তবে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় পরামর্শক নিয়োগে আগের দরপত্র প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হলে সে কাজ পায় কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে কনসোর্টিয়াম। তারা মূল সেতু ও নদী শাসনের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া ব্যবস্থাপনা পরামর্শক হিসেবে পরে নিয়োগ পায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক রেন্ডাল লিমিটেড অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস।
এর বাইরে দুই দিকের সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ করে দেশীয় কোম্পানি আব্দুল মোনেম লিমিটেড। আর ওই অংশগুলোর পরামর্শক হিসেবে কাজ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বুয়েট। এছাড়া পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার দায়িত্বেও আছে সেনাবাহিনীর ৯৯ বিগ্রেড, যা মূলত এ প্রকল্পের জন্যই গঠন করা হয়েছিল।
সব প্যাকেজের ঠিকাদার নিয়োগ শেষে দেখা যায় বেড়ে গেছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়। এজন্য প্রকল্প সংশোধন করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ব্যয় অনুমোদন করে সরকার। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি। এরপর প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন না করলেও ২০১৮ সালের জুনে আবারও ব্যয় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। সে সময় প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। মূলত ড্রেজিংয়ের স্পয়েল (মাটি) ফেলার জন্য পদ্মা নদীর চরে ১ হাজার ১৬৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের কারণে সর্বশেষ ওই ব্যয় বাড়ে।
এদিকে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর মূল কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর প্রথম স্প্যান বসানো হয় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের মাঝে প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছিল। আর শেষ স্প্যান বসানো হলো ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। যদিও ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের নভেম্বরে সেতু নির্মাণ শেষ করার কথা। তবে নকশা জটিলতায় তা পিছিয়ে যায়।
প্রথম স্প্যান বসানোর আগেই ২০১৬ সালে নকশায় ত্রুটি ধরা হয়। এটি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণে চতুর্থ তথা শেষ চ্যালেঞ্জ। সে বছর পদ্মা সেতুর প্রতিটি পিলারের জন্য পরীক্ষামূলক পাইলিং শেষ হয়। এজন্য মাটির গুণাগুণ পরীক্ষায় সয়েল টেস্ট করা হয়। এতে পুরো নদীজুড়ে ১৪টি পিলারের নকশায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। পিলারগুলোর পাইলিংয়ের শেষ প্রান্তে বা তার কিছুটা নিচে ৩৮০ থেকে ৪০০ ফুট গভীরতায় ধরা পড়েছে কাদার স্তর। ফলে পিলারগুলোর নকশা অনুমোদন আটকে যায়। পরে আরও ৮টি পিলারে প্রায় কাছাকাছি ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
সব মিলিয়ে ২২ পিলারের নির্মাণকাজ তথা পাইলিং বন্ধ রাখা হয়। এটি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণকালীন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর তা সমাধানে দফায় দফায় চলে বিশেষজ্ঞ কমিটি তথা প্যানেল অব এক্সপার্টের মিটিং। পরবর্তীতে সেতুটির নকশা প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুক্তরাজ্যের কাউয়িকে দায়িত্ব দেয়া হয় সমস্যা সমাধানের জন্য। তারা নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সম্ভাব্য তিনটি সুপারিশ তুলে ধরে। এর একটি ছিল পাইলকে কাদার স্তরের বেশকিছুটা উপরে শেষ করা। দ্বিতীয়টি ছিল কাদার স্তর পার করে আরও গভীর পর্যন্ত পাইল নিয়ে যাওয়া। তৃতীয়টি ছিল প্রতিটি পিলারের জন্য প্রস্তাবিত ছয়টি পাইলের মাঝে আরেকটি করে পাইল দিয়ে পিলারের শক্তি বৃদ্ধি করা। আর মাঝের পাইলটি খাঁজকাটা (স্কিন গ্রাউটিং) ধরনের নির্মাণ করা, যাতে তা মাটিকে আঁকড়ে থাকে। এর মধ্য থেকে তৃতীয়টি গ্রহণ করা হয়।
নকশা সমস্যা সমাধান করে সবগুলো পাইল ও পিলার নির্মাণ করতে লেগে যায় বর্ধিত অনেকটা সময়। এজন্য দফায় দফায় বাড়তে থাকে পদ্মা সেতুর নির্মাণের মেয়াদকালও। ২০১৮ থেকে ২০২০, ২০২১ ও সর্বশেষ ২০২২ সাল পর্যন্ত বেড়েছে এর মেয়াদকাল। তবে সর্বশেষ মেয়াদ বৃদ্ধির পেছনে দায়ী মূলত কভিড-১৯। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে পদ্মা সেতুর চীনা ঠিকাদারদের বড় একটি দল বড়দিন ও নববর্ষ উদযাপনে চীনে গিয়ে আটকে যায়। এতে জনবলের অভাবে পিছিয়ে যায় সেতুর নির্মাণকাজ।
এর বাইরে ২০২০ সালে আকস্মিক বড় ধরনের বন্যায় পদ্মায় পানির স্রোত অনেক বেড়ে যায়। এতে সেতুটির স্প্যান বসানোও বাধাগ্রস্ত হয়। শুধু তা-ই নয়, পানির তোড়ে সেতুটির জন্য নির্মিত মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের বড় একটি অংশ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। তাই এই কভিড ও আকস্মিক বন্যা ছিল সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ। সব মিলিয়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জ জয় করে সর্বশেষ স্প্যান বসানো হয়েছে সেতুটির।
এরপরও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজকে আরেক দফায় বিপাকে ফেলে। ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যন্ত্রপাতি ও নির্মাণসামগ্রী আমদানি ব্যাহত হয় এ যুদ্ধের কারণে। এতে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ আরও পিছিয়ে চলতি বছর ডিসেম্বরে গিয়ে ঠেকবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। তবে বিবিএ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে জুনের মধ্যেই কাজ শেষ করে।
অর্থায়ন: পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। যদিও শেষ পর্যন্ত তা আরও কিছুটা বাড়তে পারে। বর্তমান ব্যয়ের মধ্যে ৩০০ কোটি টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। বাকি ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দেয়া হয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষকে। এ ঋণ পরিশোধে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট চুক্তি সই করে সেতু কর্তৃপক্ষ ও অর্থ বিভাগ।
ঋণচুক্তি অনুযায়ী, সেতু কর্তৃপক্ষ ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে অর্থ বিভাগ তথা বাংলাদেশ সরকারকে ঋণ পরিশোধ শুরু করবে। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ৩৫ বছর। এক শতাংশ সুদে এ ঋণ পরিশোধ করা হবে। এতে সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা।
টোল হার: ঋণচুক্তির শর্তের মাঝেই পদ্মা সেতু ব্যবহারের জন্য টোল হার উল্লেখ ছিল। পরে তা গেজেট আকারে জারি করা হয়। এতে পদ্মা সেতুতে বাইক পারাপারে টোল দিতে হবে ১০০ টাকা। প্রাইভেট কার ও জিপে টোল দিতে হবে ৭৫০ টাকা, পিকআপে এক হাজার ২০০ টাকা এবং মাইক্রোবাসে এক হাজার ৩০০ টাকা। এছাড়া ছোট বাসে (৩১ আসনের কম) টোল এক হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাসে (৩২ আসন বা তার বেশি) দুই হাজার টাকা এবং বড় বাসে (তিন এক্সেল) দুই হাজার ৪০০ টাকা।
পণ্যবাহী যান চলাচলের জন্য ছোট ট্রাকে (পাঁচ টনের কম) টোল এক হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাকে (পাঁচ থেকে আট টন) দুই হাজার ১০০ টাকা এবং বড় ট্রাকে (আট টনের বেশি) দুই হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া পদ্মা সেতুতে তিন এক্সেলের ট্রাকে টোল দিতে হবে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা। এর বাইরে পণ্যবাহী চার এক্সেলের ট্রেইলারে টোল ছয় হাজার টাকা। আর চার এক্সেলের বেশি হলে ছয় হাজার টাকার সঙ্গে পরবর্তী প্রতি এক্সেলের জন্য দেড় হাজার টাকা করে অতিরিক্ত টোল যোগ হবে।
অর্থনৈতিক লাভ: পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে উপকৃত হবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীরা। ওই অঞ্চলে সম্প্রসারণ হবে বিনিয়োগ ও শিল্পোৎপাদন। কমবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। এতে সব মিলিয়ে ৩১ বছরে পদ্মা সেতু থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা (ইকোনমিক বেনিফিট) মিলবে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
২০১৬ সালে পরিচালিত ‘ইকোনোমিক কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস: পদ্মা ব্রিজ প্রজেক্ট’ শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। কোপেনহেগেন কনসানসেস সেন্টার, স্মার্ট সল্যুশনস ফর বাংলাদেশ ও ব্র্যাকের যৌথ উদ্যোগে গবেষণাটি পরিচালনা করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) অব বাংলাদেশের সিনিয়র ইকোনোমিস্ট আশিকুর রহমান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার।
২০১০ সালে এ ধরনের আরেকটি গবেষণা পরিচালনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক সেলিম রায়হান ও বজলুল হক খন্দকারের পরিচালিত ওই গবেষণায় দেখা যায়, ৩১ বছরে সেতুটি থেকে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা অর্থনৈতিক বেনিফিট পাওয়া যাবে। অর্থাৎ নির্মাণকাজ বিলম্বিত হওয়া ও ব্যয় বাড়লেও পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক লাভ কমেনি। বরং কিছুটা বেড়েছে।
২০১৬ সালের গবেষণায় দেখা যায়, সেতুটি ব্যবহারের ফলে ২৩ শতাংশ সময় সাশ্রয় হবে। এতে গাড়ি পরিচালনা ব্যয়ও কমবে। সব মিলিয়ে ৩১ বছরে সেতু ব্যবহারকারীদের বেনিফিট দাঁড়াবে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সেতুটি নির্মাণের ফলে বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন উৎসাহিত হবে। এতে অর্থনীতির সার্বিক বেনিফিট হবে ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে সেতুটির পরোক্ষ প্রভাব বিবেচনা করলে বেনিফিট আরও বেড়ে যাবে।
আর সেতুটিতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে যান চলাচল কম হলে এর ইকোনোমিক বেনিফিট কিছুটা কমবে। সে ক্ষেত্রে ৩১ বছরে বেনিফিট দাঁড়াবে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সেতুটি ব্যবহারকারীদের বেনিফিট থাকবে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি অর্থনীতির সার্বিক বেনিফিট হবে ২০ হাজার কোটি টাকা।
অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য: ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতু নির্মাণকালেই কয়েকটি রেকর্ড করে ফেলেছে। প্রথমটি সেতুর পাইলিং নিয়ে। পদ্মা সেতুর পিলারের (ইঞ্জিনিয়ারিং ভাষায় পিয়ার) নিচে সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীরে স্টিলের পাইল বসানো হয়েছে। এসব পাইল তিন মিটার ব্যাসার্ধের। বিশ্বে এখন পর্যন্ত কোনো সেতুর জন্য এত গভীরে পাইলিং প্রয়োজন হয়নি এবং এত মোটা পাইল বসানো হয়নি।
দ্বিতীয় রেকর্ড হলো, ভূমিকম্পের প্রতিরোধ সক্ষমতা বিয়ারিং সংক্রান্ত। এই সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিংয়ের’ সক্ষমতা হচ্ছে ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে।
পদ্মা সেতুর পাইলিংয়ের কাজে ব্যবহƒত তিন হাজার কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারটিও বিশ্বে সেতু নির্মাণে ব্যবহƒত সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যামার। আর সেতুটির স্প্যান টেনে নিয়ে যেতে চার হাজার টন ক্ষমতার ক্রেন ব্যবহারও বিশ্বে অন্যন্য ঘটনা।
প্রধান প্রতিবেদক, শেয়ার বিজ