খেলাপি ঋণ আদায় চট্টগ্রামে জুনে ৫৪টি মামলা

 

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম : ব্যবসার প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ সময়মতো পরিশোধ না করায় গত মাসে চট্টগ্রামের ৫৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান মোট ৫৪টি মামলা দায়ের করেছে। এর মধ্যে ২১টি মামলা দায়ের করেছে বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক। মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছে চট্টগ্রামের একাধিক শীর্ষ ব্যবসায়ীসহ পাইকারি দোকানদার। মামলা দায়ের করা হলেও পাওনা আদায়ের চিন্তিত অধিকাংশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপকরা।

সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও অর্থঋণ আদালত সূত্রে জানা যায়, ভোজ্যতেল আমদানিকারক, আবাসন নির্মাতা, পোশাক উৎপাদন  ও জাহাজভাঙা শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের পাইকারি পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হতে ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ করতে না পেরে খেলাপি হয়ে পড়ে চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ী। আর এসব খেলাপি ঋণ আদায়ে চলতি বছরের জুন মাসে চট্টগ্রামের ৫৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ৫৪টি মামলা করে।

এর মধ্যে আছে ব্যাংকিং খাতের বহুল আলোচিত ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান লিজেন্ড হোল্ডিংয়ের বিরুদ্ধে পাওনা আদায়ে আরেকটি মামলা দায়ের করে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ন্যাশনাল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা মার্চ মাসে ১৪২ কোটি ঋণ দায়ে মামলা দায় করে।

আরেক আলোচিত প্রতিষ্ঠান সিলভিয়া গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মেসার্স মিশম্যাক শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে মামলা করে মার্কেন্টাইল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা। এ প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকটির পাওনা ৩০০ কোটি টাকা।

গ্রাহক প্রতারণায় খ্যাত আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান নাইট ফ্র্যাঙ্ক ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের বিরুদ্ধে খেলাপি ঋণের জন্য দুটি মামলা করে ইউসিবিএল।

মামলার রেজিস্টার অনুসারে, পাওনা আদায়ে সবচেয়ে বেশি মামলা করে ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা। এ ব্যাংকের মোট মামলার সংখ্যা ২১টি। এ ব্যাংকটি পাওনা আদায়ে চলতি বছরের মার্চ মাসেও মোট ১৭ মামলা করে শীর্ষে অবস্থানে ছিল। তারপর জুন মাসে যৌথভাবে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সোনালী ব্যাংক ও লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেড। এ আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটি পৃথকভাবে সাতটি করে মোট ১৪টি মামলা করে। আর ব্র্যাক ব্যাংক, আইডিএলসি ও ঢাকা ব্যাংক প্রত্যেকে তিনটি করে মামলা দায়ের করে। আর দুটি করে মামলা করে ইউসিবিএল ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড। পাওনা আদায়ে একটি করে মামলা করে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড,  জনতা, উত্তরা, ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক ও এবি ব্যাংক।

ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানগুলো হলো মেসার্স গাউসিয়া ফিশ ট্রেডার্স, মেসার্স আবুল খায়ের স্টোর, মেসার্স ফাতেমা অটোমোবাইল,  বিসমিল্লাহ স্টোর, মেসার্স তকদির ভাণ্ডার স্টোর,  নাহিদ উদ্দিন মাহমুদ, পান্না চৌধুরী, নাসির উদ্দিন, এম রাশেদ উদ্দিন, আহম্মদ রেজাউল মোস্তফা,  মেসার্স তৈয়রিয়া মামুন স্টোর,  মেসার্স আওশি এন্টারপ্রাইজ, রোবেল অ্যান্ড ব্রাদার্স, মেসার্স শোকরিয়া ইন্টারন্যাশনাল,  মেসার্স ট্রেড কালেকশন, মেসার্স তামিম ফিশ, মেসার্স নিউ পার্টি সেন্টার, মেসার্স জুয়েল ট্রেডার্স, মেসার্স আর পি ট্রেডার্স,  মেসার্স মল্লিক ট্রেডার্স, শাহ মজিদিয়া লাইব্রেরি, মো. আফসার খান, গ্লোরি ইলেকট্রিক হাউজ, মেসার্স এ জামাল অ্যান্ড ব্রাদার্স, বেদ বিশ্বাস নাথ, কামরুল আমান চৌধুরী, আল রাফিয়া সেনিটারি, আবসার খান রাসেল, জাবেদ আফসার চৌধুরী, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী, ফকরুদ্দিন আহমেদ মোজাম্মেল হক চৌধুরী, মেসার্স শানিম আয়রন,  মেসার্স কাশেম এন্টারপ্রাইজ, চয়েস গার্মেন্ট, ফয়সাল আমিন, মেসার্স জব্বারিয়া ফেব্রিক্স, এসএইচ ইলেকট্রনিকস, এআর ট্রেডিং, আকবর শাহ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স কেআই এনটারপ্রাইজ, বাংলাদেশ বেলটিং কর্পো, হাজী আলী আহম্মদ, মনেরেস সু-স্টোর, মেসার্স ফাতেমা স্টোর, মেসার্স সিকদার চিংড়ি খামার,  মেসার্স দিগন্ত মৎস্য খামার, মেসার্স মাবিয়া সু-স্টোর এবং মেসার্স হযরত মানতি গিফট অ্যান্ড ক্রোকারিজ হাউজ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর সব ধরনের ব্যাংকিং খাতে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শেষে ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণ ছিল ৫২ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। এ হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ছয় শতাংশ। এ খেলাপি ঋণের বাইরে অবলোপন করা (যে ঋণ আদায়ের আশা ছেড়ে দিয়ে আর্থিক হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়) ঋণের পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসেবে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকার বেশি হয়। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছয় লাখ ৩০ হাজার ১৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

ব্যাংক, ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন ও আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংক ঋণের সুদ বেশি, ব্যবসায়িক অদক্ষতা, টানা লোকসান, ব্যাংকের দায় পরিশোধে ব্যর্থতা ও আন্তর্জাতিক বাজারে ধারাবাহিক দরপতনে কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের এমন অবস্থা। একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় তা নিষ্পত্তি করবেন।

মোস্তফা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংক এশিয়ার উদ্যোক্তা জহির উদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ঋণ কাটিয়ে ওঠার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত প্রকৃত ব্যবসায়ীদের দীর্ঘমেয়াদি সুদ আরোপ স্থগিত করে দীর্ঘ মেয়াদি কিস্তিতে পরিশোধে সুযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি নতুনভাবে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করতে হবে। পাশাপাশি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে গুণগত মান, সঠিক ব্যবসায়ী যাচাই, এক খাতে একাধিক ব্যবসায়ীকে ঋণ না দেওয়া, কৃষি ও উৎপাদনমুখী খাত দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ইত্যাদি বিবেচনা করতে হবে। এ ছাড়া নতুন ব্যাংকের নিবন্ধন না দেওয়াসহ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ঋণ গ্রহণের ক্ষমতা সীমিত করা। তিনি আরও বলেন, আমার গ্রুপের ঋণের বিপরীতে এ পর্যন্ত হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করলেও মূল ঋণের টাকা কমেনি। ব্যাংকগুলো সুদের ওপর সুদ গুনে যাচ্ছে।

মামলার বাদী ব্যাংকগুলো একাধিক শাখা ব্যবস্থাপকরা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যার ফলে মামলা করতে হচ্ছে। গত কয়েক বছরে কিছু ব্যবসায়ী আত্মগোপনে চলে যাওয়া ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ফলে এসব পাওনা আদায়ে খুব চিন্তিত আছি।’

উল্লেখ্য, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামে অর্থ ঋণ আদালতের ঋণ ও সুদ আদায়ে মোট ২৪৭টি  মামলা করা হয়। এ ছাড়া গত বছর মোট মামলা হয়েছে ৭৪৪টি। এর আগে ২০১৫ সালে মামলা দায়ের হয় ৯৫৮টি। ২০১৪ সালে ৪৫৪টি।

 

 

 

 

 

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০