মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগ আসছে। পাশাপাশি আসছে বড় বিনিয়োগ। আর এ বড় বিনিয়োগে নাম লেখাচ্ছেন সাবেক ও বর্তমান আমলারা। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের নামে বড় বিনিয়োগ নিয়ে সক্রিয় এখন আমলারা। কয়েকজন সাবেক আমলা রীতিমতো গ্যাম্বলারের ভূমিকায় নেমেছেন। স্বল্প সময়ে বাজার থেকে মুনাফা তুলে নিতে তারা বাজারে সক্রিয় হয়েছেন বলে জানা গেছে। একাধিক সিকিউরিটি হাউজের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, সম্প্রতি রূপালী ব্যাংকের শেয়ারের দর বৃদ্ধিতে দুজন আমলা জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে একজনই তিন লাখ শেয়ার কিনেছেন। অন্য কোম্পানি বিডি ওয়েল্ডিংয়ের শেয়ারের দর বৃদ্ধির নেপথ্যে মালিকপক্ষসহ একজনসহ একাধিক আমলা জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়। মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এ শেয়ারের দর বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি। কয়েক কার্যদিবসের ব্যবধানে ১৪ টাকার শেয়ারদর বেড়ে ২১ টাকায় লেনদেন হয়। সমর্থিত সূত্রে জানা যায়, একইভাবে প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দর বৃদ্ধিতে আমলাদের হাত রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাজেটের পর হঠাৎ সক্রিয় হয়ে পড়েন সাবেক ও বর্তমান আমলারা। জুনের মাঝামাঝি সময়েই তারা আয়কর রেয়াত পাওয়ার জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করেন। জুলাই মাসেও এ ধারা অব্যাহত থাকে। বাজার চাঙ্গা হওয়ার পেছনেও তাদের ভূমিকা রয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে একটি বড় সিকিউরিটি হাউজের সিইও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুঁজিবাজারে সাধারণত বড় বিনিয়োগ করেন বড় ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি বড় ব্যাংকাররাও বিনিয়োগ করেন। কিন্তু ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের বিনিয়োগ কমে আসছে। এ জায়গা দখল করেছেন এখন আমলারা। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে এনে তারা এখন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছেন। তাদের বিনিয়োগের অঙ্কটাও বেশ বড়। বতর্মান বাজার বিনিয়োগের জন্য খুবই সম্ভাবনাময়। আর এ সুযোগ নিচ্ছেন ধনী আমলারা।
জানা গেছে, পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছেনÑএরকম কয়েকজন সাবেক আমলার আমন্ত্রণে বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শতাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাজারে সক্রিয় হয়েছেন। তারা মূলত কম মূলধনি ও জেট গ্রুপের শেয়ারে বিনিয়োগ করে শেয়ারের দর বাড়াচ্ছেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী, যারা ব্যাংক ও সিকিউরিটি হাউজেরও মালিক। তাদের মাধ্যমেই বাজারে লেনদেন বাড়ছে, বাড়ছে সূচক।
সম্প্রতি বিডি ওয়েল্ডিং, আজিজ পাইপস, বিচ হ্যাচারি, রহিমা ফুড, শাইনপুকুর সিরামিক, সিনোবাংলাসহ বেশকিছু দুর্বল প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর বেড়েছে। মাসের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দর বেড়েছে ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত। যে কারণে গত এক মাসে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে শোকজ করেছে ডিএসই। যার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধিরা। এসব কোম্পানির শেয়ারের দরবৃদ্ধিতেও তাদের হাত ছিল বলে জানা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ হেলাল মনে করেন, বেশ কিছু কারণে আমাদের বাজারে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা সহজ। কারণ জেড ক্যাটাগরির শেয়ারের লেনদেন নিষ্পত্তিতে ১০ দিন সময় লাগে। এসব শেয়ার বিক্রি করে অন্য শেয়ার কেনা যায় না। এর জন্য ১০ কার্যদিবস সময়ের প্রয়োজন হয়। ফলে কারসাজিকারীদের পক্ষে ‘জেড’ ক্যাটাগরির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা সহজ। আগে থেকে কিছু শেয়ার কিনে তারপর ধাপে ধাপে দাম বাড়িয়ে আস্তে আস্তে হাতের শেয়ারগুলো ছেড়ে দেন। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দাম বাড়াতে শুরু করলে সেসব শেয়ারের প্রতি আকৃষ্ট হন। একপর্যায়ে কারসাজিকারী সব শেয়ার বিক্রি করে ওইসব কোম্পানি থেকে বেরিয়ে যান। তখনই এসব কোম্পানির অস্বাভাবিক দরপতন ঘটতে থাকে।
শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা বিএসইসির পক্ষ থেকে ১১ ধরনের কারসাজির কথা বলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি অভিনবই বলে জানিয়েছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। কারসাজিগুলো হলো স্বয়ংক্রিয় গ্রাহক বা অটো ক্লায়েন্ট, শটসেল চক্রাকার লেনদেন ইত্যাদি। এসবের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে চক্রাকার লেনদেন। এক্ষেত্রে কারসাজির আওতায় দাম বাড়াতে পরিকল্পিতভাবে একাধিক ব্যক্তির মধ্যে কৃত্রিম লেনদেনের মাধ্যমে দাম প্রভাবিত করে। এসব কারসাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন আমলারা।
কোনো ধরনের সংবেদনশীল তথ্য না থাকার পরও লাগামহীন দর বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক মনে করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই। তাদের অভিমত, ইতোমধ্যে এসব শেয়ার অতি মূল্যায়িত হয়ে গেছে। এসব কোম্পানিতে কারসাজি হচ্ছে বলে তারা অভিমত প্রকাশ করেন।
Add Comment