১৯৭১ গণহত্যা: জুন

কাজী সালমা সুলতানা : ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বিনাশ করতে গোটা দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করে। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছেন বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। এখন পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধকালে দীর্ঘ ৯ মাস ধরেই পাকিস্তানি বাহিনীরা গণহত্যা সংঘটিত করে। ১৯৭১ সালের জুন মাসে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়

কোদালিয়া শহিদনগর গণহত্যা: ১ জুন ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলায় কোদালিয়া শহিদনগর ইউনিয়নে পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা সংঘটিত করেন। সেদিন সকাল আনুমানিক ৯টার সময় ভাঙ্গা ফরিদপুর সদর মুকসুদপুর হতে পাকিস্তানি সেনারা নগরকান্দার ৯টি গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং তাদের সৈন্যদের লাশ উদ্ধার করার জন্য ঘোড়ামারা বিলের কাছে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ সৈন্য একত্র হয়।

পাকিস্তানি সৈন্যদের আসতে দেখে নগরকান্দার আশপাশের আতঙ্কিত গ্রামবাসী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। কোদালিয়া গ্রামের নারী-পুরুষ ও শিশুসহ প্রায় ৪০-৬০ জন মিয়াবাড়ির পাশের জঙ্গলে একটি ডোবার মধ্যে আত্মগোপন করার চেষ্টা করেন। কৌশলগত কারণে আব্দুল আজিজ মোল্লার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আত্মগোপন করেন।

পাকিস্তানি সৈন্যরা মিয়াবাড়ির জঙ্গল ঘেরাও করে সেখান হতে সবাইকে বের করে আনে। এরপর তারা নারী ও তিন বছরের নিচের শিশুদের একটি, চার থেকে ১৫ বছরের শিশুদের একটি এবং পুরুষদের একটি মোট তিন ভাগে ভাগ করে। নারীদের কোদালিয়া মসজিদ-মাদরাসায় নিয়ে রাখে। পুরুষদের দিয়ে ২৯ মে  মুখোমুখি যুদ্ধে নিহত পাকিস্তানি সেনাদের মৃতদেহ ও লুটের মালামাল মাথায় তুলে দিয়ে নগরকান্দা থানায় পাঠিয়ে দেয়, আর কিছু লোককে মাদরাসার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখে।

সেনারা ৪-১৫ বছরের শিশুদের বিলের ওপর একটি জায়গায় অপেক্ষায় রেখে বলে, তোমাদের মা রান্না করছে রান্না শেষ হলে তোমাদের যার যার মায়ের  নিকট পাঠিয়ে দেয়া হবে। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত তাদের অনাহারে বন্দি করে রাখা হয়। এদিকে নারী ও তাদের শিশুদের (তিন বছরের নিচে) মাদরাসার মাঠে বসিয়ে রেখে, নারীদের বলা হয় তোমরা কোরআন-তসবিহ পড়।  অনেকে বলে, আমাদের সঙ্গে কোরআন নেই, বাড়িতে আমরা গিয়ে নিয়ে আসি। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা বলে, এখন আনতে হবে না, যা  জান তাই পড়।

সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কোনো ধরনের খাবার পানি না দিয়ে তাদের মাঠে প্রখর রোদের মধ্যে বসিয়ে রাখা হয়। শিশুদের পানি খেতে দেয়া হয়নি।

 বিকাল সাড়ে ৩টায় হঠাৎ করে পাকিস্তানি সেনারা সবাইকে পানি খাওয়াতে থাকে সবাইকে গোল করে মাদরাসার মাঠের এক কোনায় বসিয়ে তাদের কলমা পড়ানো হয়। এরপর তাদের মাথা নিচু করে বসিয়ে মেশিন গান দিয়ে গুলিবর্ষণ করে হত্যা  করা হয়। এরপর তাদের মৃতদেহগুলো মোটা কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। সেনারা বন্দি থাকা শিশুদের ছেড়ে দিয়ে বলে, তোমার মা মাদরাসায় মাঠে ভাত রান্না করে রেখেছে তোমরা যাও। শিশুরা এসে দেখে তাদের মা এবং ছোট ভাইবোনদের মৃতদেহ কম্বল দিয়ে মোড়ানো। গুলিতে কোদালিয়া গ্রামের শিশু, নারী শিশুসহ ১৭ জন শহীদ হয়, দুজন নারী ও তিনজন শিশু আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে যায় আর অগ্নিসংযোগ করে তিনজনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

 সেদিন কোদালিয়া শহিদনগর ইউনিয়নের বেশিরভাগ পুরুষ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কারণে গণহত্যা থেকে বেঁচে যায়। একই দিন পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ১১৭ জনের বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে অনেক নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়। তারা অনেক বয়স্ক গ্রামবাসীদের ধরে নিয়ে যায় ও তাদের বলে দুদিন আগের যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্য যারা নিহত হয়েছে তাদের লাশ খুঁজে দাও, নয় তো তোমাদের হত্যা করা হবে।

ছাতনী গণহত্যা: ৪ জুন হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে শহিদ হন চার শতাধিক বাঙালি। সেদিন রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী নাটোরের ছাতনীতে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। রাজাকার হাফেজ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৪ জুন গভীর রাতে নাটোরের ছাতনী গ্রামসহ আশপাশের ১০টি গ্রামে হানা দেয়। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুমন্ত লোকজনকে ধরে পিঠমোড়া করে বেঁধে ছাতনী সøুইসগেটে এনে গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এরপর লাশগুলো অ্যাসিডে ঝলসে দেয় ঘাতকরা। তারা চলে গেলে গ্রামবাসী মরদেহগুলোকে ছাতনী সøুইসগেটসহ আশপাশের পুকুর ও ডোবায় কোনো রকমে মাটিচাপা দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর উত্তরাঞ্চলের হেড কোয়ার্টার ছিল নাটোরে। নয় মাস হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা নাটোরের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালিয়েছে। এর মধ্যে নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী গ্রামের গণহত্যা ছিল ভয়াল, নৃশংস ও হƒদয়বিদারক। ছাতনী গ্রামের অবস্থান নাটোর শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা তৎকালীন এমসিএ শংকর গোবিন্দ চৌধুরীর বাড়ি ছাতনী গ্রামে হওয়ায় এই জনপদের অধিকাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এ কারণে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর অবাঙালি বিহারিদের আক্রোশে পড়ে এই এলাকা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীসহ কয়েকশ বিহারি ৪ জুন গভীর রাতে ছাতনী গ্রামসহ আশপাশের ১০টি গ্রামে ঢুকে ঘুমন্ত মানুষদের তুলে নিয়ে এসে হত্যা করে। ফজরের আজানের পূর্ব মুহূর্তে কিছু লোক বিষয়টি টের পাওয়ায় এলাকার অনেক মানুষের জীবন রক্ষা পায়। শহিদ মনির সরকারের পুকুর রক্তে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। যারা ফিরে আসে তারা কয়েকজন মিলে ৫-৬টি করে মরদেহ একসঙ্গে চাপা দিয়ে রাখে। অনেক মরদেহ শনাক্ত করাই সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

কাঁঠালবাড়ী গণহত্যা:  ৯ জুন কুড়িগ্রাম শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে কাঁঠালবাড়ী বাজার ও আশপাশের ৬টি গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী দেশীয় দালালদের সহযোগিতায় হত্যা করে ৩৫ জন নিরপরাধ বাঙালিকে। সেই সঙ্গে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ধবংসস্তূপে পরিণত করেছিল এসব গ্রাম।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পাকিস্তানি বাহিনী ওইদিন সকালে কাঁঠালবাড়ী বাজারের তিন দিক থেকে অতর্কিত আক্রমণ করে, অগ্নিসংযোগ করে বাজার ও কয়েকটি গ্রামে। এতে বাজারের শতাধিক দোকান ও শিবরাম, সর্দারপাড়া, সন্ন্যাসী, ফকিরপাড়া, প্রামাণিকটারী ও খামার গ্রামের ৫ শতাধিক পরিবারের বাড়ি-ঘর পুড়ে যায়। এলোপাতাড়ি হত্যাযজ্ঞে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন ৩৫ জন মানুষ। গুলি করে হত্যার পর কাউকে কাউকে আগুনে পুড়িয়ে দেয় হানাদাররা। (চলবে)

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০