ঘুরে এলাম ময়নামতি

ক্লাস, পরীক্ষা আর ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার ব্যস্ততাকে ছুটি জানিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসাটা ছিল বহু আকাক্সিক্ষত। প্রাচীন ঐতিহ্যের শহর ‘কুমিল্লা’ ছিল প্রথম পছন্দ। ঘুরে এসে ঐতিহাসিক নিদর্শন নিয়ে লিখেছেন হেলাল উদ্দিন

দৈনন্দিন রুটিনে যখন পরিশ্রান্ত আমরা তখনই সব কিছুকে ক্ষণিক সময়ের জন্য ছুটি দিয়ে সিদ্ধান্ত হলো ঘুরতে যাওয়ার। স্থান কুমিল্লার প্রাচীন নিদর্শনগুলো। ভ্রমণ তালিকায় ছিল ময়নামতি জাদুঘর, শালবন বিহার, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, কোটিলা মুড়া, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি স্থান।

যাত্রা শুরুর গল্প

সিলেট থেকে রাতের ট্রেনে চেপে বসলাম লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্যাম্পাস সাংবাদিকতায় সম্পৃক্ত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেস ক্লাব সদস্যরা। প্রথম লক্ষ্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। সকালে পৌঁছানোর পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নাস্তা পর্ব শেষ করে বের হয়ে পড়লাম। গন্তব্য ময়নামতি জাদুঘর। এখানে ইটাখোলা মুড়া, রাণীর বাংলা, শ্রী ভবদেব মহাবিহার, কোটিলা মুড়া, রূপবান মুড়া, আনন্দ বিহার, ভোজ রাজার বাড়ি বিহার ও চারপত্র মুড়ার  অনেক মূল্যবান পুরাসামগ্রী সংগৃহীত আছে। প্রসঙ্গত পুরাবস্তু সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য ১৯৬৫ সালে কুমিল্লার কোটবাড়ীর শালবন বিহারের দক্ষিণ পাশে একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়। জাদুঘর ভবনে ৪২টি আধার রয়েছে। এসব আধারেই পুরাবস্তুসমূহ প্রদর্শিত হচ্ছে। আধারগুলোতে প্রতœতাত্ত্বিক স্থান খননের উম্মোচিত স্থাপত্যসমৃদ্ধ ধ্বংসাবশেষের

7ব্রোঞ্জমূর্তি, ঘরে ব্যবহৃত মাটির হাড়ি-পাতিল, ভূমি-নকশা, প্রাচীন মুদ্রা, ধাতু লিপি ফলক, পোড়া মাটির ফলক, পাথরের মূর্তি, লোহার পেরেক, পাথরের গুটিকা, অলঙ্কারের অংশ এবং মুদ্রক-মুদ্রিকা প্রদর্শিত হচ্ছে। জাদুঘরে প্রদর্শনের উল্লেখযোগ্য পাথর ও ব্রোঞ্জমূর্তি হচ্ছে: বিভিন্ন ধরনের পাথরের দণ্ডায়মান লোকোত্তর বুদ্ধমূর্তি, তারামূর্তি, মারীছী মূর্তি, মঞ্জুরের মূর্তি, পার্বতীমূর্তি, হরগৌরীমূর্তি, মহিষমর্দিনী মূর্তি, ত্রি বিক্রম বিষ্ণুমূর্তি, নন্দীমূর্তি, মনসামূর্তি, গণেশমূর্তি, সূর্যমূর্তি, হেরুকমূর্তি এবং ব্রোঞ্জের বজ সত্ত্ব মূর্তি। টিকিট কেটে যে কেউ এখানে প্রবেশ করতে পারে।

জাদুঘরের পাশে রয়েছে বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম শালবন বৌদ্ধ বিহার। এটি ১২শ’ প্রত্ততাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। কুমিল্লার ময়নামতিতে খনন করা সব প্রত্ততাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে শালবন বিহার অন্যতম। বিহারটির আশপাশে এক সময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল বলে এর নাম হয়েছে শালবন বিহার। ধারণা করা হয় যে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এ বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করেন। শালবন বিহারের একেকটি বাহু ১৬৭.৭ মিটার দীর্ঘ। বিহারে ১৫৫টি কক্ষ আছে। কক্ষের সামনে ৮.৫ ফুট চওড়া টানা বারান্দা ও তার শেষ প্রান্তে অনুচ্চ দেয়াল। কক্ষগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন। তারা সেখানে বিদ্যাশিক্ষা ও ধর্মচর্চা করতেন।

3শালবন হয়ে এবারের গন্তব্য বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড)। কুমিল্লা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে কোটবাড়ীতে এর অবস্থান। ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচনে নিরলস সহায়তা করে যাচ্ছে বার্ড।

এরপর ঘুরে দেখি বার্ডের পাশে প্রায় একই সমতলে অবস্থিত রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া ও কোটিলা মুড়া। রূপবান মুড়া ঢিবিটিতে বিহারের দৈর্ঘ্য ৩৪.১৪ মি. প্রস্থ ২৫ মি. ও মন্দিরের দৈর্ঘ্য ২৮.৯৬ মি. প্রস্থ ২৮.৯৬ মি.। এর সময়কাল ধরা হয় সপ্তম থেকে ১২শ’ শতাব্দীর মধ্যে।

ইটাখোলা মুড়া, ১৩.১ মি. ভিতের উপর অবস্থিত এ বিহার প্রাচীনকাল হতে ইটপোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হতো বলে এমন নাম রাখা হয়েছে। এ বিহারে প্রত্ততাত্ত্বিক অনুসন্ধানে বড় বড় কিছু বৌদ্ধস্তূপ ও এসব স্তূপ থেকে ৪২ মিটার উত্তরে সংলগ্ন একটি বৌদ্ধ মঠের সন্ধানও পাওয়া গেছে।

তারপর কোটিলা মুড়া, যা আব্বাসীয় খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহর সময়কার একটি অন্যতম নিদর্শন। স্থাপনাটির কার্যকাল ছিল সাত শতক থেকে তের শতক পর্যন্ত। এ মুড়া খননের ফলে পাশাপাশি নির্মিত প্রধান তিনটি বৌদ্ধ স্তূপের নিদর্শন পাওয়া গেছে, এ স্তূপগুলো বৌদ্ধ ধর্মের ত্রি-রত্ন বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের প্রতীক।

প্রাচীন নিদর্শনগুলোতে বুঁদ হয়ে ছিলাম এতোক্ষণ। কবে যে সূর্যের তেজ আকাশময় গোধুলির রং ছড়িয়ে লীন হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি।

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০