ইসমাইল আলী: খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’এ কথা বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী এ কথা প্রায়ই বলে থাকেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ কথা একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। গত বছর সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘জাতিসংঘ ফুড সিস্টেমস সামিট ২০২১’-এ তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে।
গত ৬ মার্চ একই দাবি করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, কোনো ঘাটতি নেই। যদিও বাস্তব চিত্র তার উল্টো তথ্যই দেখাচ্ছে। নিয়মিতই বাংলাদেশ খাদ্যশস্য আমদানি করে থাকে। প্রধান দুই খাদ্যশস্যও (চাল ও গম) এর বাইরে নয়। বিশেষত গত দুই অর্থবছর গমের পাশাপাশি রেকর্ড পরিমাণ চাল আমদানি করেছে বাংলাদেশ। সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই এ আমদানি হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে দেশে চাল আমদানি হয় ৯ লাখ ৮৯ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সরকারিভাবে আমদানি করা হয় ছয় লাখ ৮৪ হাজার ৪০ মেট্রিক টন ও বেসরকারিভাবে তিন লাখ পাঁচ হাজার ৬৬০ মেট্রিক টন। আর বিদায়ী অর্থবছর গম আমদানি করা হয়েছে ৪০ লাখ ১২ হাজার ১২০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সরকারিভাবে আমদানি করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার ১২০ মেট্রিক টন ও বেসরকারিভাবে ৩৪ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন। সব মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর খাদ্য আমদানি করা হয়েছে ৫০ লাখ এক হাজার ৮২০ মেট্রিক টন।
২০২০-২১ অর্থবছর চাল আমদানি করা হয়েছিল ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ১৭০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সরকারিভাবে আমদানি করা হয় পাঁচ লাখ ৭২ হাজার ৮৯০ মেট্রিক টন ও বেসরকারিভাবে সাত লাখ ৮৬ হাজার ২৮০ মেট্রিক টন। ওই অর্থবছর গম আমদানি করা হয়েছিল ৫৩ লাখ ৪২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সরকারিভাবে আমদানি করা হয় চার লাখ ৭৮ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন ও বেসরকারিভাবে ৪৮ লাখ ৬৪ হাজার ১০০ মেট্রিক টন। সব মিলিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছর খাদ্য আমদানি করা হয়েছিল ৬৭ লাখ এক হাজার ৯৭০ মেট্রিক টন।
এ হিসাবে বিদায়ী অর্থবছর চাল আমদানি কমেছে ২৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। আর গম আমদানি কমেছে ২৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর সার্বিকভাবে খাদ্য আমদানি কমেছে ২৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
এদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছর দেশে রেকর্ড পরিমাণ চাল উৎপাদন হয়। এতে ওই অর্থবছর নামমাত্র চাল আমদানি করা হয়, যার পরিমাণ ছিল মাত্র চার হাজার ১৮০ মেট্রিক টন। এগুলো মূলত ছিল বাসমতি ধরনের চাল, যার পুরোটাই বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি করা হয়। যদিও ওই অর্থবছর গম আমদানির পরিমাণ স্বাভাবিকই ছিল।
২০১৯-২০ অর্থবছর দেশে গম আমদানি হয়েছিল ৬৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৪০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সরকারিভাবে আমদানি করা হয় তিন লাখ ৬৭ হাজার ৫৯০ মেট্রিক টন ও বেসরকারিভাবে ৫৯ লাখ ৯৮ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন। সব মিলিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর খাদ্য আমদানি করা হয়েছিল ৬৩ লাখ ৬৯ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন। এছাড়া ওই অর্থবছর খাদ্য সহায়তার আওতায় কিছু গম পাওয়া যায়, যার পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৫৮০ মেট্রিক টন।
এদিকে চলতি অর্থবছর চাল আমদানি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না বাংলাদেশ। এরই মধ্যে বেসরকারি উদ্যোগে চার লাখ ৯ হাজার টন চাল আমদানি করতে ৯৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এই অনুমোদনের ভিত্তিতে ৩০ হাজার টন আতপ চাল এবং তিন লাখ ৭৯ হাজার টন সিদ্ধ চাল আমদানি করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।
বোরো মৌসুম শুরুর পরও দেশের বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় সরকার চাল আমদানির অনুমতি দেয়ার উদ্যোগ নেয়। এজন্য গত ২৬ জুন আগ্রহী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাহিদাপত্র আহ্বান করা হয়। ৩০ জুন চাল আমদানির জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর নামের তালিকা প্রকাশ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগামী ২১ জুলাইয়ের মধ্যে চাল আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খুলে সে প্রতিবেদন খাদ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। আর ১১ আগস্টের মধ্যে আমদানি করা চাল বাজারজাত করতে হবে। পাশাপাশি আমদানি করা চাল গুদামজাত করার তথ্য জেলা প্রশাসককে জানাতে হবে। আমদানির পর সেই চাল স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠানের নামে পুনঃপ্যাকেট করা যাবে না, আমদানির বস্তায় বিক্রি করতে হবে। আর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এলসি করতে না পারলে বরাদ্দ আদেশ বাতিল হয়ে যাবে।
সূত্রমতে, গত দুই মাস ধরে সরু চালের দাম কেজিতে ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে সরু চাল ৮০ টাকা থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল মাঝারি ও মোটা চালের দাম। বর্তমানে বাজারে মোটা চাল ৫০ টাকা থেকে ৫৫ টাকা এবং মাঝারি চাল ৫৫ টাকা থেকে ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে সরবরাহ বাড়ানো ও বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে চার মাসের জন্য চালের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে সরকার। গত ২৩ জুন এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে চাল আমদানিতে মোট শুল্ক ২৫ শতাংশ করা হয়।
এর আগে চাল আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক, ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, পাঁচ শতাংশ অগ্রিম কর এবং পাঁচ শতাংশ অ্যাডভান্সড ট্রেড ভ্যাটসহ (এটিভি) মোট ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ আমদানি শুল্ক ছিল। বর্তমানে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ১৫ শতাংশের পাশাপাশি অগ্রিম কর হিসেবে পাঁচ শতাংশ এবং অগ্রিম আয়কর পাঁচ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
ভোক্তাদের স্বস্তিতে রাখতে প্রয়োজনে শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানি করা হবে বলে সম্প্রতি জানিয়েছিলেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তিনি বলেছিলেন, অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে, যা করণীয় তার সবই করা হবে। প্রয়োজনে ট্যাক্স কমিয়ে চাল আমদানি করে ভোক্তাকে স্বস্তিতে রাখা হবে।