দুর্বল কাঠামো নিয়েই অনুমোদন হয়েছে বাজেট : সিপিডি

 

নিজস্ব প্রতিবেদক: নতুন ভ্যাট বাস্তবায়ন হবে ধরে নিয়ে রাজস্ব প্রাক্কলন করে সংসদে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে নতুন আইন বাস্তবায়ন হলো না। কিন্তু রাজস্ব সংগ্রহ ও বাজেট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রায় কোনো পরিবর্তন করা হলো না। ফলে যে কাঠামোটি দাঁড়ালো, তা যথেষ্ট বলিষ্ঠ নয়। একটি দুর্বল কাঠামোর ওপর ভর করেই বাজেট অগ্রসর হচ্ছে। এ বাজেট বাস্তবায়নের জন্য বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আর জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ও ভিশন-২০৪১ অর্জন করতে হলে এখন থেকেই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়ে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।

‘জাতীয় বাজেট ২০১৭-১৮ অনুমোদন-পরবর্তী পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ কথা জানায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে এ মিডিয়া ব্রিফিংয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গত কয়েক বছরের বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, আয় বৃদ্ধির প্রাক্কলন ব্যয় বৃদ্ধির প্রাক্কলনের তুলনায় দ্রুত বাড়ছে। এ বিষয়টি ইতিবাচক। এছাড়া উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধির প্রাক্কলন অনুন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধির প্রাক্কলনের চেয়ে দ্রুত বাড়ছে। এ বিষয়টিও ভালো। তবে এবার যে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে, তা একটি দুর্বল কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কারণ নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হবে ধরে নিয়ে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল। আইনটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখন রাজস্ব কম আহরণ হবে। ফলে ব্যয় মেটানো কঠিন হবে। এক্ষেত্রে আয় যেহেতু কম হবে, সেক্ষেত্রে সরকার ব্যয়ের প্রাক্কলনও কমিয়ে হয়তো ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হতে পারে।

তিনি বলেন, নতুন আইন বাস্তবায়ন না হলেও বিদ্যমান রাজস্ব ব্যবস্থার আরও ভালো প্রয়োগ ঘটিয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো সম্ভব। আর নতুন আইন বাস্তবায়ন না হওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অন্যান্য খাতের দিকে বেশি জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে ডাইরেক্ট ট্যাক্স একটি ভালো খাত হতে পারে। এছাড়া এনবিআরবহির্ভূত কর ও করবহির্ভূত খাত থেকে আয় বাড়ানোর বিষয়ে জোর দিতে হবে।

নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়টিকে তিনি ‘ক্র্যাশ ল্যান্ডিং’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নতুন ভ্যাটের প্লেন উড়তে পারেনি; মুখ থুবড়ে পড়েছে। নির্বাচনের পর যাতে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে না হয়, সে জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই অনলাইন ব্যবস্থাসহ অন্য প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। ক্র্যাশ ল্যান্ড করা প্লেন আবার ওড়াতে হবেÑএটাই মূল চেষ্টা হওয়া উচিত।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নতুন আইনের পক্ষে সিপিডি। যদি ১২ শতাংশ একক ভ্যাট হার নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া হতো, তবে নতুন আইনের এ পরিণতি নাও হতে পারতো। তিনটি কারণে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বলে মনে করে সিপিডি। এগুলো হলো প্রস্তুতির অসম্পূর্ণতা, রাজনৈতিক সহমতের অভাব ও সামাজিক তাৎপর্যের বিষয়টি বিবেচনায় না নেওয়া।

সিপিডি আরও বলেছে, চলতি অর্থবছরে (২০১৭-১৮) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কতটা অর্জিত হবেÑএ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে সিপিডি। সিপিডি বলছে, রাজস্ব আদায়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, একদিকে টাকা বিদেশে চলে যাবে, অন্যদিকে সৎ করদাতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবেÑএটা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। টাকা পাচারকারীর নাম-পরিচয় জানার পরও যদি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, আবার সৎ করদাতাদের ওপর করের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, এতে ন্যায়বিচার হয় না। সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। এমনিতেই নির্বাচনের বছরে টাকা পাচার বৃদ্ধি পায়।

বাজেটে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের মূলধন জোগানে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার সমালোচনা করেছে সিপিডি। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেন, এ টাকা দেওয়া উচিত নয়। সিন্ধুর মধ্যে বিন্দুর মতো তা তলিয়ে যাবে। তিনি বলেন, নতুন ব্যাংকের পাশাপাশি প্রথম প্রজšে§র বেসরকারি ব্যাংকও এখন সমস্যায় পড়েছে। ব্যাংক অভ্যন্তরে সুশাসনের অভাব আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে নজরদারি করার কথা ছিল, তা হয়নি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এ আবর্জনা পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। এখনই সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত।

সিপিডি মনে করে, বাজেটের ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে বেশি ঋণ নেওয়ায় সরকারের দায় বাড়ছে। এতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এটি মধ্য মেয়াদে টেকসই হবে না। ব্যাংক থেকে কম সুদে ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। সিপিডি আরও মনে করে, সঞ্চয়পত্র সামাজিক সুরক্ষার বিষয় নয়। অন্যভাবে খরচ করে সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া যেতে পারে।

দীর্ঘ মেয়াদে আর্থিক খাত দেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে চারটি কমিশন গঠনের সুপারিশ করে সিপিডি। এর মধ্যে আর্থিক খাতে সুশাসন ফেরানোর জন্য একটি স্বতন্ত্র সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের গুণগত মান নিশ্চিতের জন্য সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশন, কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিতের জন্য মূল্য কমিশন ও যথাসময়ে গুণগত উপাত্তের সরবরাহ নিশ্চিত করতে একটি পরিসংখ্যান কমিশন গঠনের প্রস্তাব করে সিপিডি। সংস্কারমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে এসডিজি ও উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন সহজ হবে বলে মনে করে সিপিডি।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান সঞ্চারী হতে হবে। এ জন্য অর্থনীতি বহুমুখীকরণ করতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি নিতে হবে। উৎপাদনশীলতানির্ভর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, পরিচালক (সংলাপ ও মিডিয়া) আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ, গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০