নিজস্ব প্রতিবেদক: বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে বিদ্যুৎ ও তেলের খরচ কমানোর জন্য একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বলা হয়েছে, ডিজেলের দাম ‘আকাশচুম্বী’ হয়ে যাওয়ায় আপাতত দেশের ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন স্থগিত রাখা হবে। পাশাপাশি সপ্তাহে এক দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, এখন কয়লা থেকে ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, গ্যাস থেকে ৫০ দশমিক ৮৪ শতাংশ, ফার্নেস অয়েল থেকে ২৮ শতাংশ এবং ডিজেল থেকে ছয় শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বালানি সাশ্রয় নীতির কারণে দিনে এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
সেই ঘাটতি সমন্বয় করতে গ্রাহক পর্যায়ে দিনে এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হবে, আর এলাকাভিত্তিক এ লোডশেডিং শুরু হবে আজ থেকেই। কোথায় কখন লোডশেডিং হবে, তা জানিয়ে দেবে বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিগুলো।
সোমবার সকালে জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বৈঠকে অফিসের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, ভার্চুয়ালি অফিস করা, এসি ব্যবহারে সংযমী হওয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকটের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘ধৈর্য ধরে যদি আমরা এটাকে সহ্য করে সবাই মিলে অতিক্রম করি, তাহলে ইনশাল্লাহ, ভবিষ্যতে আবার সুদিন আসবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আজকে যা আলোচনা করেছি, তার উল্লেখযোগ্য দিক হলো আমরা আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে, যাতে আমাদের খরচ কম হয় সেই পর্যায়ে, যেটা সহনশীল হয়, সেই পর্যায়ে নিয়ে আসা এবং ডিজেলে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন আপাতত স্থগিত করলাম। তাতে অনেক টাকা সাশ্রয় হবে।’
সংবাদ সম্মেলন শেষে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আজ থেকে সপ্তাহে এক দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস উপস্থিত ছিলেন সংবাদ সম্মেলনে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মঙ্গলবার থেকে হবে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং, দিনে এক থেকে দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে না। আপাতত ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থগিত থাকবে, দিনে বিদ্যুতের ঘাটতি হবে ১০০০-১৫০০ মেগাওয়াট। জ্বালানি আমদানির খরচ কমাতে সপ্তাহে এক দিন বন্ধ থাকবে পেট্রোল পাম্প। গাড়িতে তেলের ব্যবহার কমাতেও পদক্ষেপ আসছে, প্রজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হবে। রাত ৮টার পর দোকানপাট ও বিপণিবিতান বন্ধ রাখার পুরোনো সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। অফিস-আদালতে কিংবা বাসায় এসি ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে রাখতে হবে, মসজিদে নামাজের সময়ের বাইরে এসি চালানো যাবে না। কাজ ঠিক রেখে অফিসের কর্মঘণ্টা এক থেকে দুই ঘণ্টা কমানোর পরিকল্পনা। সরকারি-বেসরকারি অফিসের সভা করতে হবে ভার্চুয়ালি।
তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্র, যাদের অনেক টাকাপয়সা আছে, তারাও লোডশেডিংয়ে যাচ্ছে। ব্রিটেনে হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ায় হচ্ছে, জাপানে হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও, ব্যাংকে অর্থ থাকা সত্ত্বেও সংবরণ করছে। আজকের আলোচনার একটা মুখ্য বিষয় হচ্ছে, আমরা আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনকে কমিয়ে আনব, যাতে আমাদের খরচ কম হয়।’
সারাদেশে এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই ঘাটতি অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করে নিতে হবে। তাতে দিনে এক থেকে দেড় ঘণ্টা, কোনো কোনো জায়গায় দুই ঘণ্টাও লোডশেডিং হতে পারে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং পৃথিবীর এই দুর্যোগপূর্ণ সময় আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
তিনি জানান, কীভাবে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো যায়, বৈঠকে তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। রাত ৮টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করা, অফিসে কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, প্রয়োজনে বাসা থেকে ভার্চুয়ালি অফিস করা, সরকারি গাড়িতে বেশি লোক পরিবহন করাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের সাশ্রয়ী হতে হবে। সেই সাশ্রয়ী হওয়ার কারণে আমরা এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ে চলে যাচ্ছি। সেটা আমরা আগে থেকে জানিয়ে দেব। বিশেষ করে গাড়িতে যাতে তেল কম ব্যবহার করা হয়, সেজন্য কিছু মেজারস নেয়া হচ্ছে। সেটা পর্যায়ক্রমে জানিয়ে দেয়া হবে। এটা খুব দীর্ঘমেয়াদি নয়।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘কোন এলাকায় পর্যায়ক্রমে কতক্ষণ বিদ্যুৎ থাকবে না, সেটা বিতরণ কোম্পানিগুলোর জানিয়ে দেবে। শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক গ্রাহকরা বিদ্যুৎপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে, এরপর অন্য গ্রাহকরা বিদ্যুৎ পাবে। সবাইকে ধৈর্য ধরে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শুরু হওয়া এই বিশেষ পরিস্থিতি থেকে অচিরেই আমরা মুক্তি পাব বলে আমি আশা করি।’
শিল্প ও বাণিজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা তুলে ধরে নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমরা প্রায়োরিটি দেব ইন্ডাস্ট্রিতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের, বাণিজ্যে যেন বিদ্যুৎ পায়।’
বৈদেশিক বাণিজ্যে লেনদেন ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতিতে থাকা বাংলাদেশ বিদেশি মুদ্রা বাঁচানোর জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেল আমদানিতে এলসি পেতে সমস্যা হচ্ছে বলে সম্প্রতি খবর এসেছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যুতের ১০ শতাংশ এবং অন্যন্য খাত থেকে আরও ১০ শতাংশ, মোট এই ২০ শতাংশ ডিজেল সাশ্রয় করতে পারলে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আমরা সেভ করতে পারব, এটা অনেক বড় বিষয় হবে। এ সিদ্ধান্ত আমরা না নিলে সারাবছর এই ১০ শতাংশ ডিজেলের যে দাম দিই, সেই মূল্য তো আমরা বিদ্যুৎ থেকে পাব না। ডিজেল থেকে যে বিদ্যুৎ হয়, তা ৩৫ থেকে ৪০ টাকার মতো পড়ে প্রতি ইউনিট। বিদ্যুৎ বিক্রি করছি গড়ে প্রায় সাত টাকায়।’
ডিজেল আমদানি কমালে ভর্তুকির খরচও কমবে হবে বলে মন্তব্য করেন নসরুল হামিদ।
এখন জ্বালানির আমদানি খরচে রাশ টানতে ডিজেলের দিকে নজর দিয়েছে সরকার। বিপিসির হিসাবে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩০ লাখ ৬৩ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়েছে। এ সময় অপরিশোধিত তেল এসেছে আট লাখ ৭০ হাজার টন।
নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের এটা অনুভব করতে হবে যে, বিশ্বের সব দেশই কোনো কোনোভাবে জ্বালানি সংকটের শিকার হচ্ছে।’ জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘বিপিসি মূল্যবৃদ্ধির জন্য জানিয়েছে। আমরা এ বিষয়টাও লক্ষ রাখছি। প্রাইস অ্যাডজাস্ট করলেই তো সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের দেখতে হবে কতটুকু সাশ্রয় করলে আমরা চলতে পারি। তার পরবর্তী অবস্থায় মেজারস আমরা কী নেব?’ তবে সরকার আপাতত সমন্বয়ে না গিয়ে গ্রাহকদের জন্য মূল্য স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
সপ্তাহে এক দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধের বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বিপিসি পেট্রোল পাম্প মালিক সমিতির সঙ্গে বসবে। সপ্তাহে এক দিন বন্ধ রাখতে পারি কি না, সেটা চিন্তাভাবনা করব।’
উপাসনালয়ে এসি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে নামাজের সময়টুকু এসি ব্যবহার করে বাকি সময় বন্ধ রাখতে অনুরোধ করেন তিনি।