মানবিক উৎকর্ষ সাধনে অর্জিত শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা

আরফাতুর রহমান শাওন: যে বিদ্যা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায় না তাই পুঁথিগত বিদ্যা। যে শিক্ষার সঙ্গে জ্ঞানার্জনের বিশেষ কোনো সম্বন্ধ নেই, কেবল জীবিকার জন্য ব্যবহƒত হয় তাই পুঁথিগত বিদ্যা। কথায় আছে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষার ওপর লেখালেখি গবেষণা হয়েছে অনেক। কিন্তু স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই কি সঠিক শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব? পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি কর্ম জীবনের পথ নির্দেশনার গাইডলাইন মাত্র। আমাদের দৈনিক শিক্ষা বলে যে একটি কথা রয়েছে তার সমন্বয়ে যখন পুঁথিগত শিক্ষার আবির্ভাব ঘটে এবং সেই দৈনিক শিক্ষা যদি মানব কল্যাণে সুন্দর ও সময়োপযোগী হয় এবং তা যদি ‘ক্রিয়েট সাম ভ্যালু ফর ম্যানকাইন্ড’ তখনই এই দৈনিক শিক্ষার সঙ্গে পুঁথিগত শিক্ষার মিশ্রণের প্রতিফলনকে বলতে পারি সুশিক্ষা। তাই এটি বলাই যথার্থ হবে, শুধু শিক্ষা নয়,? সুশিক্ষাই হোক জাতির মেরুদণ্ড। প্রচলিত পুঁথিগত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা খুঁজে পায় না কোনো বিনোদন। কারণ একাডেমিক শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বা বিনোদনের কোনো সম্বন্ধ থাকে না। অথচ জ্ঞানার্জনই বিনোদনের সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। আর সৃজনশীল ও মানবিক উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে যে শিক্ষা অর্জিত হয় তাই প্রকৃত শিক্ষা।

জ্ঞানার্জনের পিপাসা নিয়ে, সেবার মানসিকতা নিয়ে পেরুতে হবে শিক্ষাঙ্গন। যে জাতি যত বেশি জ্ঞানী, সে জাতি তত বেশি মানবিক। যে জাতি যত বেশি ন্যায়পরায়ণ, সে জাতি তত বেশি ত্যাগী। জ্ঞানার্জনের পিপাসা মানুষকে দান করে অমরত্ব। অর্জিত জ্ঞানের আলো আলোকিত করে একটু একটু করে পৃথিবীকে।

প্রত্যাশিত ও প্রয়োজনীয় গুণের, মাপের, মানের ও মাত্রার শিক্ষার ক্ষেত্র তৈরি হয়নি এ দেশে এখনও। তাই চিন্তা ও চেতনায় প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় জীবনে পশ্চাৎমুখী বলয়ে রয়ে গেছে। পুঁথিগত বিদ্যায় বিদ্যানরা পৌঁছাতে পারে না ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার আনুকূল্যে। অনুমান, আন্দাজ, কল্পনাপ্রসূত প্রথা পদ্ধতির সঙ্গে এক প্রকার সমন্বয় করে জীবন অতিবাহিত করে। পুঁথিগত বিদ্যার গুণ, গৌরব-গর্ব নিয়ে আস্থাভাজন হন সুজান ও সজ্জনে। এক কথায় আত্মসেবী শ্রেষ্ঠ নাগরিক বনে যান। বিদ্যা মানুষকে অর্জন করতে হয় নিজ পরিবার, প্রতিবেশ, প্রতিকূলতা ও প্রকৃতি থেকে। বোধ থেকে, বিবেক থেকে, নিজের জšে§র পরিমণণ্ডল থেকে। দেশি-বিদেশি বই ও পত্রিকা পড়া অব্যাহত রাখার মধ্য দিয়ে। অন্যের সুখে ও দুঃখে শরিক হয়ে, হোক সে পশু কিংবা প্রতঙ্গ, হোক সে সংখ্যালঘু কিংবা ভিনদেশি, বিধর্মী। প্রকৃত শিক্ষিত ব্যক্তির চোখের গভীরতা, হƒদয়ের প্রসারতা আর দৃষ্টিভঙ্গির দূরদর্শিতা বিশ্ব সভ্যতার জন্য আশীর্বাদ। প্রকৃত শিক্ষা যেন জ্ঞানার্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, আর জীবিকার মাধ্যম হোক কর্মমুখী শিক্ষা। জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হোক সৃজনশীল শিক্ষা। বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা হোক গবেষণামূলক।

এখন প্রশ্ন হলো, কী করে পাওয়া যাবে সুশিক্ষা? এমন কোনো উদাহরণ কি আছে! আজকের নতুন প্রজন্মেরও মেধাবী প্রতিনিধিরাই আগামী দিনের বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন বিশ্বমানের শিক্ষা পেয়ে সুনাগরিক হতে পারে। যেকোনো জায়গার শিক্ষার্থীর সঙ্গে শুধু তাল মিলিয়েই চলা নয়, উন্নত প্রযুক্তিটাও যেন সে আয়ত্ত করতে পারে। সেই ভাবেই তাদের গড়ে তুলতে হবে। কারণ, আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে হবে।

বাস্তবমুখী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এই শিক্ষার প্রধান উৎস হলো পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ভালো বই এবং সৎ সঙ্গী। একজন ব্যক্তিকে বাস্তবমুখী শিক্ষা অর্জনে মুখ্য ভূমিকা রাখে, তার পরিবার। কেননা পরিবারের মাধ্যমে কোনো মানব শিশু শিক্ষা পেয়ে থাকে, কীভাবে তার জীবনের সব প্রতিকূলতা জয় করে সফলতা অর্জন করতে পারে। এর জন্য বাবা-মা তথা অভিভাবকদের উচিত সন্তানের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা। যেন তার সন্তান ভালো রেজাল্ট নয়, ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম। আর ভালো বই এবং সৎসঙ্গীও শিক্ষার একটি উপাদান। ভালো বই মানুষের জ্ঞান সম্প্রসারণে এবং আত্মশক্তি বাড়াতে সহায়তা করে। অন্য দিকে সৎসঙ্গী মানুষকে সৎ উপদেশ, বিপদে সাহায্য, ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। এতে করে একজন মানুষ আত্মপ্রতিষ্ঠিত হতে অনুপ্রেরণা পায়। সঙ্গে সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক দিক হতে কীভাবে একজন শিক্ষার্থীকে যথাযথ বাস্তবমুখী শিক্ষা দেয়া যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।

জীবন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মনো-সামাজিক দক্ষতার বিকাশ ঘটিয়ে শিক্ষকরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিকূল অবস্থা ও সমস্যা মোকাবিলা এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করতে পারেন। সে জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বিকল্প নেই। আবার বলা হয়েছে জীবন দক্ষতা হচ্ছে মনো-সামাজিক দক্ষতা, যা আমাদের নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাতে ও সমস্যা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে। নীতি নৈতিকতা এবং বাস্তব জীবনে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা দরকার অথবা এর সম্পর্কিত অন্য বিষয়ের সঙ্গে জীবন ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

বিজ্ঞান যুগে যুগে মানুষকে সঠিক পথ দেখিয়েছে। বর্তমানে আমরা আধুনিক ও উন্নত মানুষ বলতে মূলত একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকেই বুঝি। তাই দেশের সার্বিক উন্নতিকল্পে বিজ্ঞান শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়ার বিকল্প নেই। বিজ্ঞানের শিক্ষা বিশ্লেষণধর্মী ও বাস্তবমুখী। তাই বৈজ্ঞানিক উপায়ে কোনো কাজের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন করাই সর্বোত্তম। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কেবল এর মাধ্যমেই সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারি। তাছাড়া বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমেই কেবল আমাদের জীবনসংস্কৃতিতে উন্নয়ন সূচিত হতে পারে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে সমানভাবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান শিক্ষা তাই অপরিহার্য। যারা বিজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে জড়িত তাদের অধিকাংশই আবার না বুঝে কেবল পাঠ মুখস্থ করে। পরীক্ষায় পাস করাকেই কৃতিত্ব বলে ভাবছে। অসচেতন অভিভাবক ও শিক্ষকগণও এ বিষয়ে তাদের উৎসাহিত করছেন। ফলে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হয়েও তারা বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠছে না।

প্রাথমিক থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সব স্তরে বিজ্ঞানের বই সুখপাঠ্য করে রচনা করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিষয়ে পড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এছাড়া বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেয়া দরকার। দরিদ্র শিক্ষার্থীরা যাতে বিজ্ঞান পড়ার প্রতি অনাগ্রহী না হয় সেই লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও উদ্যোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়া এবং অবকাঠামো তৈরিতে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। পাশাপাশি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের অর্জিত শিক্ষাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে সেই লক্ষ্যে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।

বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হাতেকলমে বাস্তবধর্মী শিক্ষাই হলো কারিগরি শিক্ষা। অর্থাৎ যে শিক্ষা ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে দেশের শিক্ষার্থী সমাজকে দক্ষ এবং বাস্তসম্মত জ্ঞানের অধিকারী হিসেবে করে গড়ে তোলে। বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় কারিগরি শিক্ষাকে চাকরির ক্ষেত্রেও খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। তাই সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিযোগিতার বাজারে কারিগরি শিক্ষা যোগ্য প্রতিযোগী তৈরিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

দেশের প্রতিটি জায়গা থেকে যদি হাজারো মানুষের দৈনিক শিক্ষার প্রতিফলন ঘটানো যায়, তাহলে অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করা এবং ধর্ম, গণতন্ত্র, সমৃদ্ধি, বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করা ও একই সঙ্গে ভণ্ডামী ও অনৈতিকতা থেকে বেরিয়ে এসে দেশ ও জাতির সেবা করা সম্ভব। যা-ই হোক, সমাজের প্রয়োজনে পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে শিক্ষার ব্যবহারিক অনুশীলনের সমন্বয় ঘটিয়ে সুশিক্ষার জন্য কাজ করতে হবে।

 শিক্ষক

মিল্লাত উচ্চবিদ্যালয়

বংশাল, ঢাকা

mdarfaturrahman1@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০