চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সব সম্ভাবনা কাজে লাগাবে স্মার্ট বাংলাদেশ

তাসনিম রিদওয়ান: নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্বাচনী ইশতেহারে ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন, যার মূল শিরোনাম ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার ও বিকাশের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়ে ২০২১ সালের মধ্যেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে ‘ভিশন-২০২১’ বা ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের ঘোষণা করা হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের চার স্তম্ভ কানেক্টিভিটি, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই-গভর্ন্যান্স ও আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশনের আলোকে গত ১৩ বছরে নানা উদ্যোগ ও উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হওয়ায় দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব প্রসার ঘটেছে।

১৩ বছর আগে তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিলেন। তার পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে ডিজিটাল শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ এখনও ‘ফাইভ-জি’ চালুর বিষয় চিন্তাও করেনি, অথচ বাংলাদেশে এরই মধ্যে ‘ফাইভ-জি’ চালু হয়েছে। ২০২৩ সালে আসছে তৃতীয় সাবমেরিন কেব্ল। সরকার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট উচ্চগতির ডেটা দিচ্ছে, যার মাধ্যমে প্রযুক্তির প্রসার ঘটছে। আগামীর পৃথিবী হবে ডেটানির্ভর। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকবে। ডেটার চাহিদা পূরণে ইকো সিস্টেম দাঁড় করাতে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে এবং গ্রাহক স্বচ্ছন্দে তা গ্রহণ করছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটকে সাশ্রয়ী ও জনবান্ধব করার জন্য এরই মধ্যে সরকার ‘একদেশ একরেট’ প্যকেজ চালু করেছে।

২০১৮ সালের ১২ মে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ব স্যাটেলাইটের এলিট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সুবিধা এখন দেশবাসী পাচ্ছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম জন্ম থেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে গড়ে উঠেছে। তাদের কাছে তথ্যপ্রযুক্তি খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। অথচ বিষয়টি আজ থেকে এক যুগ আগেও স্বপ্নের মতো ছিল।

বৈশ্বিক কভিড অতিমারির সময় সবকিছু যখন বন্ধ ছিল, তখন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষাসহ অতি প্রয়োজনীয় ও জরুরি সেবা সচল রাখা হয়েছিল। কভিড মোকাবিলায় দেশীয় আই প্রকৌশলীদের দ্বারা তৈরি ‘সুরক্ষা অ্যাপ’ চালু করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে ভ্যাকসিন নিবন্ধন, ভ্যাকসিনের তথ্য সংকলন, ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট ইস্যু প্রভৃতি কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের দেশের আইটি প্রকৌশলীরা এ কাজের মাধ্যমে তাদের দক্ষতাই শুধু প্রমাণ করেননি, এর মাধ্যমে দেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা, দেশপ্রেম এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়েছে। দেশবাসী তাদের এ পরিশ্রমকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করেছে। কভিড পড়ৎড়হধ.মড়া.নফ ওয়েব পোর্টালে তিন কোটি ৭৫ লাখেরও অধিকবার তথ্য ও সেবার জন্য নাগরিকরা যুক্ত হয়েছেন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মেশিন ইন্টেলিজেন্সও বলা হয়। কম্পিউটার সায়েন্সের উৎকৃষ্টতম উদাহরণ হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি প্রধানত যে চারটি কাজ করে তা হলো কথা শুনে চিনতে পারা, নতুন জিনিস শেখা, পরিকল্পনা করা এবং সমস্যার সমাধান করা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স স্মার্টফোনে ব্যবহার হচ্ছে সুন্দর সেলফি তুলতে, গ্রাহকের অভ্যাস ও প্রয়োজনীয়তা মনে রেখে কাস্টমাইজড সেবা প্রদান করা, ভয়েস শুনে বিভিন্ন সেবা প্রদান প্রভৃতি।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গত বছর বিজয় দিবসে সিটি ব্যাংক ‘বিকাশ’-এর সঙ্গে যৌথভাবে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। এ ঋণ প্রদানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিকাশ হিসাবধারী বিকাশ অ্যাপ ব্যবহার করে ঋণের জন্য আবেদন করলে সিটি ব্যাংক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঋণ মঞ্জুর করে দেবে। এখানে কোনো মানুষের সাহায্য লাগবে না। আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। কোনো জামানত ও কাগজপত্র লাগছে না। ব্যাংকের কোনো ঋণ প্রসেসিং ফিও নেই। বিকাশ অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স থেকে মাসিক ভিত্তিতে ঋণ আদায় করা হয়ে থাকে। ইন্টারেস্ট রেটও সহনীয়। সারাবছর ২৪ ঘণ্টাই এ সুবিধা গ্রাহকরা পাচ্ছেন। ব্যাংক খাতে এটা একটা যুগান্তকারী কার্যক্রম। এছাড়া গার্মেন্ট কারখানায় রোবটের ব্যবহার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ওয়ালটন কারখানায় ফ্রিজের কম্প্রেসার অ্যাসেম্বল করতে ব্যবহার করা হচ্ছে রোবোটিক প্রযুক্তি। আইসিডিডিআর,বি ‘কারা’ নামে টেলি অপথালমোলজি প্রযুক্তি দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যান্সি শনাক্তের একটি আধুনিক পদ্ধতি চালু করেছে। ‘বন্ডস্টাইন ‘সফলভাবে মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানোর জন্য আই ও টি ডিভাইসের মাধ্যমে স্মার্ট ট্র্যাকিং ব্যবহার করে আসছে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষকে ১০০ বছর সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এখনকার প্রজন্ম আগের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত ও সচেতন হচ্ছে। আমাদের শিশু-কিশোররা জন্ম থেকেই টেকনোলজির দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অফুরন্ত সম্ভাবনা নিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিশ্ববাসীর দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। বাংলাদেশ ইতিবাচকভাবে এ চ্যলেঞ্জ মোকাবিলা করে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বে নিজেকে পরিচিত করতে সক্ষম হবে, এটাই প্রত্যাশা।

বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’ ভিশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ গঠিত হয়েছে। সরকারের পরবর্তী ভিশন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’ বাস্তবায়নে ১৪টি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আর এসব সিদ্ধান্ত এসেছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’-এর তৃতীয় সভায়। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’-এর আওতায় প্রধান অঙ্গ হবে স্মার্ট শিক্ষা, স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট কৃষি, স্মার্ট বাণিজ্য, স্মার্ট পরিবহণ প্রভৃতি। অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলা এবং পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসতে ডিজিটাল ইনক্লুশন ফর ভারনারেবল এক্সেপশন (ডাইভ) উদ্যোগের আওতায় আত্মকর্মসংস্থানভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ, স্মার্ট ও সর্বত্র বিরাজমান সরকার গড়ে তুলতে ডিজিটাল লিডারশিপ অ্যাকাডেমি স্থাপন এবং এর বাস্তবায়ন করবে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। শিক্ষার্থীদের অনলাইন কার্যক্রম নিশ্চিতে ‘ওয়ান স্টুডেন্ট, ওয়ান ল্যাপটপ, ওয়ান ড্রিম’-এর আওতায় শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, যা বাস্তবায়ন করবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। কুটির, ছোট, মাঝারি ব্যবসাগুলোর জিডিপিতে অবদান বাড়াতে এন্টারপ্রাইজভিত্তিক ব্যবসাগুলোকে বিনিয়োগ-উপযোগী স্টার্টআপ হিসেবে প্রস্তুত করা হবে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে রয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। অন্টারনেটিভ স্কুল ফর স্টার্টআপ এডুকেটরস অব টুমোরো (এসেট) বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। বাংলাদেশ নলেজ ডেভেলপমেন্ট পার্ক নির্মাণ ও পরিচালনার বিষয় বাস্তবায়নে থাকছে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। সেন্টার ফর লার্নিং ইনোভেশন অ্যান্ড ক্রিয়েশন অব নলেজ (ক্লিক) স্থাপনের কাজ বাস্তবায়নে থাকছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। এজেন্সি ফর নলেজ অন অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড স্পেস হরাইজন (আকাশ) প্রতিষ্ঠার কাজ বাস্তবায়নে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। সেলফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড এন্ট্রিপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্ট (সিড) প্ল্যাটফর্ম স্থাপনের কাজ বাস্তবায়ন করবে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। কনটেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড লিংকেজ ল্যাব (সেল) স্থাপনের কাজ তথ্যপ্রযুক্তি অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করবে। সার্ভিস এগ্রিগ্রেটর ট্রেনিং (স্যাট) মডেলে সরকারি সেবা ও অবকাঠামোনির্ভর উদ্যোক্তা তৈরি করার কাজ বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল।

সকল ডিজিটাল সেবাকে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত ক্লাউডে নিয়ে আসার বিষয়টি বাস্তবায়নে থাকবে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। ডেটা নিরাপত্তা আইন, ডিজিটাল সার্ভিস আইন, শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফন্ট্রিয়ার টেকনোলজি (শিফট) আইন, ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এন্ট্রিপ্রেনিওরশিপ অ্যাকাডেমি (আইডিয়া) আইন, এজেন্সি ফর নলেজ অন অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড স্পেস হরাইজন (আকাশ) আইন, ডিজিটাল লিডারশিপ অ্যাকাডেমি আইন ও জাতীয় স্টার্টআপ পলিসি প্রণয়নের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ।

আমাদের শিশু-কিশোররা জন্ম থেকেই টেকনোলজির দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশÑক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন উন্নত বাংলাদেশ, যেখানে বসবাস করবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

পিআইডি ফিচার

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০