নিজস্ব প্রতিবেদক : বাঘ সংরক্ষণে সুন্দরবনের লোকালয়-সংলগ্ন ৬০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বেষ্টনী গড়ে তুলতে প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে বিশ্বের সর্বৃবহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে তৃতীয়বারের মতো ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘের জরিপ পরিচালনা, বাঘের শিকার প্রাণী-হরিণ ও শূকরের সংখ্যাও গণনা করা হবে এ প্রকল্পের আওতায়। গতকাল শুক্রবার বিশ্ব বাঘ দিবস-২০২২ উপলক্ষে মন্ত্রীর সরকারি বাসভননে এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব তথ্য জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন।
এ বছর বিশ্ব বাঘ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘বাঘ আমাদের অহংকার, রক্ষার দায়িত্ব সবার’। বন অধিদপ্তরে আয়োজিত আলোচনা সভায় সরকারি বাসভবন থেমে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে মন্ত্রী জানান, বনের বাইরে বাঘের লোকালয়ে আসা ঠেকাতে নাইলনের ফেন্সিং বা বেষ্টনী তৈরিসহ বাঘ সংরক্ষণ ও গবেষণা সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম শিগগির শুরু হবে। তিন বছর মেয়াদি ‘সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের’ আওতায় এসব কার্যক্রম চালানো হবে বলে জানান তিনি।
এ প্রকল্পের বিষয়ে বন অধিদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো জানিয়েছিলেন, বাঘের সংখ্যা নিরুপণ, বাঘের খাদ্য, নিরাপদ আবাসস্থলসহ নানা কার্যক্রম থাকবে এ প্রকল্পে। বাঘের বিচরণক্ষেত্র সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে (বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা) এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
বাঘের লোকালয়ে আসা ঠেকাতেও পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সুন্দরবনের যেসব নদী খাল মরে গেছে সেসব এলাকার ৬০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ‘নেট’ দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আগে ভারতের বন বিভাগ তাদের সুন্দরবনে অংশেও জাল দিয়ে সুফল পেয়েছে।
সভায় বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবন সংরক্ষণে সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী বলেন, সর্বশেষ ২০১৭-২০১৮ সালে পরিচালিত জরিপের তথ্যানুযায়ী আমাদের সুন্দরবন অংশে রয়েছে প্রায় ১১৪টি বেঙ্গল টাইগার এবং ২০২০-২০২১ সালের জরিপ অনুসারে ভারতের সুন্দরবন অংশে আছে প্রায় ৯৬টি বাঘ। আইইউসিএন গ্লোবাল স্পেসিজ রেড লিস্ট ২০২০ অনুসারে, বিশ্বে বাঘের সংখ্যা প্রায় ৪,৪৮৫টি। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হলো, সারাবিশ্বে বন উজাড় ও অবৈধ শিকারের ফলে বেঙ্গল টাইগার বিশ্বে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বাঘ সংরক্ষণে সরকারের পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী বাঘ হত্যায় কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এটিকে জামিন অযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান (২০১৮-২০২৭) প্রণয়ন করা হয়েছে। বাঘের অবাধ বিচরণ ও বংশ বিস্তারের লক্ষ্যে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশকে এলাকাকে রক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বনমন্ত্রী জানান, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জে স্মার্ট পেট্রোলিং পদ্ধতি ও ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর শিকার, পাচার ও নিধন বন্ধের কার্যক্রম চলমান আছে। বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে গঠিত ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের কর্মতৎপরতার ফলে লোকালয়ে বাঘ আসা মাত্র সংলগ্ন গ্রামগুলোতে দ্রুততম সময়ে তা জানানো এবং সে অনুযায়ী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে।

এ সময় শাহাব উদ্দিন ‘অপরাধ উদঘাটনে তথ্য প্রদানকারীকে পুরস্কার প্রদান বিধিমালা, ২০২০’ এর কথা তুলে ধরেন। এতে বাঘের ক্ষেত্রে বনাঞ্চলের ভেতরে অপরাধী ধরা হলে প্রদত্ত তথ্যের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা এবং বনাঞ্চলের বাইরে ধরা হলে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা আর্থিক পুরস্কারের বিধান রাখা হয়েছে বলে জানান।
তিনি ‘বন্যপ্রাণীর আক্রমণে জানমালের ক্ষতিপূরণ বিধিমালা-২০২১’ অনুযায়ী নিহত ব্যক্তির পরিবারকে তিন লাখ এবং আহত ব্যক্তির পরিবারকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধানও তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বর্তমানে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর জন্য সুপেয় মিঠাপানির চাহিদা মেটাতে সুন্দরবনে ৮০টি পুকুর নতুন করে খনন ও বিদ্যমান পুকুর সংস্কারের কার্যক্রম নেয়া হয়েছে।
প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার, সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ ও অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন।
আলোচনা করেন আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ রাকিবুল আমিন এবং প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু। বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম মনিরুল এইচ খান এবং বন অধিদপ্তরের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে।
২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘসমৃদ্ধ ১৩টি দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মেলনে বাঘ সংরক্ষণকে বেগবান করতে তৈরি ঘোষণাপত্রের আলোকে প্রতি বছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালন করা হয়।