ইসমাইল আলী: বর্তমানে বেসরকারি খাতে ফার্নেস অয়েল কোম্পানিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৪৩টি। এগুলোয় ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৮৫ শতাংশ বেসরকারি কোম্পানিগুলো নিজেরা আমদানি করেছে। বাকি ১৫ শতাংশ কেনা হয় বিপিসি থেকে। এক্ষেত্রে তেল আমদানির দিনের ডলারের রেটে বিল পরিশোধ করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এর পরিবর্তে বিল পরিশোধের দিনের ডলার দরে তেলের মূল্য চাচ্ছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।
যদিও তেলের দামের পাশাপাশি অন্যান্য ব্যয় বহনে ৯ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ ও জাহাজ ভাড়া পায় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। তবে এ অর্থে সন্তুষ্ট নয় কোম্পানিগুলো। এজন্য সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা)। একই ধরনের চিঠি দিয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ। এ বিষয়ে পিডিবির মতামত চেয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
সম্প্রতি বিপ্পা ও ইউনাইটেডের প্রস্তাবটি নিয়ে পিডিবির বোর্ড সভায় আলোচনা হয়। এতে বলা হয়, বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে এ বাড়তি সুবিধা দিলে পিডিবির লোকসান বাড়বে বছরে হাজার কোটি টাকা।
পিডিবির বোর্ড সভায় ইউনাইটেড গ্রুপের চিঠিটি উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ইউনাইটেড পায়রা পাওয়ার লিমিটেড কর্তৃক পটুয়াখালীতে স্থাপিত ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েল আমদানি করে। পিডিবি ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির অধীনে এ কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে কেন্দ্রটির জন্য মাসে গড়ে ১২ হাজার মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল লাগে। সরকারের অনুমতিক্রমে নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও খরচে এ তেল সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করা হয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক ছিল, তখন প্রতি টন ফার্নেস অয়েল চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত পৌঁছাতে খরচ পড়ত জাহাজ ভাড়াসহ ৩৫০ ডলার। গত মার্চ/এপ্রিলে ভাড়াসহ এ খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৮০০ ডলার। এতে ১৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল আমদানিতে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ব্যয় হতো ৫২ লাখ ৫০ হাজার ডলার। গত মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ২০ লাখ ডলার।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, পিডিবির সঙ্গে কোম্পানির স্বাক্ষরিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে বর্ণিত কোম্পানি কর্তৃক আমদানিকৃত এইচএফও’র মূল্য বিল অব লেন্ডিং ডেটে সোনালী ব্যাংকের স্পট সেলিং বিনিময় হার অনুযায়ী ডলার থেকে টাকায় রূপান্তর করে বিল পরিশোধ করে পিডিবি। কিন্তু বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে এলসি ইস্যুকৃত ব্যাংকে এলসি পেমেন্টের দিনের বিনিময় হার ৯ টাকা ৩০ পয়সা বেশি হওয়ায় ১৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল আমদানিতে ১১ কোটি ১৬ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়।
এদিকে পিডিবির কাছে কোম্পানির পাঁচ মাসের বিল পাওনা রয়েছে। এতে ইউনাইটেড পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এলসি পেমেন্টে ছয় মাসের ডেফারড এলসি ইস্যু করেছে। এক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি চার্জ ও ভেরিয়েবল চার্জের ফরেন কম্পোনেন্টের ইনভয়েস মাসের পরবর্তী মাসের ১ তারিখের বিনিময় হার ও পিডিবি কর্তৃক বিল পরিশোধের পরবর্তী তারিখের বিনিময় হারের মাঝে যে ব্যবধান সৃষ্টি হবে, তা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হবে। অন্যথায় জ্বালানি তেল আমদানিতে ডলারের বিনিময় হারের ঝুঁকি বহন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে চুক্তি সংশোধন ও ২০২১ সালের বিদ্যুৎ বিল থেকেই বিষয়টি কার্যকরের দাবি জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, গত অর্থবছর বেসরকারি খাতের ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে দুই হাজার ৭১ কোটি ৩৩ ইউনিট। এজন্য ব্যয় হয়েছে ৩৪ হাজার ২৪২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে জ্বালানি ব্যয় ছিল ২৮ হাজার ৪০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। তবে বিপ্পা ও ইউনাইটেডের ওই শর্ত মানলে এক্ষেত্রে ব্যয় আরও হাজার কোটি টাকা বেড়ে যাবে। এতে পিডিবির লোকসান বাড়বে।
পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা জানান, তেল আমদানি ও জাহাজ ভাড়া ছাড়া বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর যে খরচ হয় তা মেটানোর জন্য আমদানি মূল্যের ৯ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ দেয়া হয়। এর মধ্যে তেল মজুত, বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত পরিবহন, ব্যাংক চার্জ ইত্যাদি রয়েছে। আর আগে তেলের দাম যখন ৩৫০ ডলার ছিল, তখন কোম্পানিগুলো তার ৯ শতাংশ সার্ভিস চার্জ পেত। এখন তেলের দাম ৮০০ ডলার। এতে কোম্পানিগুলো ৮০০ ডলারের ৯ শতাংশ সার্ভিস চার্জ পাচ্ছে। ফলে তাদের আয় এমনিতেই বেড়ে গেছে। এখন ডলারের বাড়তি দাম দেয়া মানে কোম্পানিগুলোর দ্বিগুণ মুনাফার ব্যবস্থা করা। তাই এ প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তারা আরও জানান, চুক্তি অনুযায়ী তেল আমদানির তিন মাসের মধ্যে এর মূল্য পরিশোধ করতে হয়। তবে মূল্য পরিশোধে তিন মাসের বেশি লাগলে ব্যাংক হারে সুদ প্রদান করতে হয় পিডিবিকে। ফলে বিল প্রদান বিলম্বিত হওয়ায় তেল আমদানিতে লোকসান হচ্ছে বলে চিঠিতে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তাও সঠিক নয়।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ইউনাইটেড গ্রুপ ও বিপ্পা’র চিঠির বিষয়টি নিয়ে বোর্ড সভায় আলোচনা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি। পরবর্তী বোর্ড সভায় পুনরায় বিষয়টি তোলা হবে।