ফারুক আলম, লালমনিরহাট: উজানের ঢলে তিস্তায় আবারও পানি বাড়ায় লালমনিরহাটে ফের বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে জেলার নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়ে কয়েকটি বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এদিকে সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীতেও পানি বাড়তে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে জেলার কাজিপুর ও এনায়েতপুরের জালালপুর এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, এ বছর বর্ষার শুরুতে তিস্তা নদী ভাঙার প্রকোপ দেখা যায়নি। তবে তিস্তায় পঞ্চমবারের মতো পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। এরই মধ্যে লালমনিরহাটের সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের ২০টি বাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। ফসলি জমি, ঝারবাগান ও কবরস্থানও নদীতে। নদীতীরবর্তী ২৪ ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার পরিবার পানিবন্দি।
গত সোমবার হঠাৎ তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধি পায়। এদিন তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে সকালে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার দুই সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। বেলা বাড়লে বিকাল ৩টায় ১০, সন্ধ্যা ৬টায় ২৫ ও রাত ৯টায় ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আর গতকাল সকাল ৬টায় ১৫, ৯টায় ১৭, দুপুর ১২টায় ১৭ এবং বিকাল ৩টায় ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অপর দিকে হু-হু করে বাড়ছে ধরলাসহ ছোট নদীগুলোর পানি।
টানা দুই দিন পানি বৃদ্ধির ফলে নদীর ভাটিতে থাকা বেশ কিছু ইউনিয়নে ভাঙন দেখা দিয়েছে এবং পানিবন্দি পরিবারে সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নদীপারের শাহ আলম (৭৫) বলেন, আমার বাড়ি ৪০০ মিটার দূরে ছিল। ভাঙতে ভাঙতে এখন নদী এখানে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো খোঁজ নেয় না। অল্প কিছু বস্তা ফেলে গেছে হাফ কিলো দূরে। আর কোনো খোঁজ নেই।
ষাটোর্ধ্ব ছাড়াবি বেওয়া বলেন, ‘কোন্টে পাইস ভাত, কোন্টে পান ভাত! চাউলের বস্তা আনি খাচনো, তাও ফির আইজ নাই। সোক তো হামার ভাঙি গেইছে। আট-নওবার ভাঙনো। এল্যা মাইনসের জমিত আছি।’
হারেজ মিয়া, শরিফুল ইসলাম, আবু কালামসহ অনেকের পরিস্থিতি প্রায় একই রবম। তারা বলেন, পদ্মা সেতু হলো নিজের টাকায়। তিস্তা বাঁধটাও হওয়া দরকার। হাজার হাজার মানুষ চোখের পানি ফেলছে। কবরস্থান পর্যন্ত নদীতে ভেসে যাচ্ছে।
কালিগঞ্জ উপজেলায় ইন্ট্রাকো সোলার প্রজেক্ট নদীর মাঝ বরাবর বাঁধ দিয়েছে। সেখানকার তিনটি ওয়ার্ড পানির নিচে উল্লেখ করে ভোটমারি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফরহাদ হোসেন মাস্টার বলেন, আমার ইউনিয়নের সাতটি ওয়ার্ড প্লাবিত। প্রায় দুই হাজার পরিবার পানিবন্দি। শৌলমারি চরের তিনটি ওয়ার্ডের এমন কোনো বাড়ি নেই, যেখানে পানি ওঠেনি। নদীর পানি আর সমতল এক হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ত্রাণ পৌঁছায়নি। সরেজমিনে ঘুরে এসে ইএনওকে জানিয়েছি।
খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খায়রুজ্জাসান মণ্ডল বাদল বলেন, সতী নদীর পাঁচটি ও তিস্তার ৯টি বাড়ি ভেঙে গেছে। তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি। মেম্বারদের কাছ থেকে তালিকা চাওয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, খুনিয়াগাছে দেড় কিলোমিটার ভাঙন আছে। গতবারই আমরা প্রটেকশন দিয়েছি। এবারও ৬০০ মিটারের কাজ হয়েছে। নদীতীর কিছু ভাঙছে। আমরা প্রপোজাল পাঠিয়েছি। অনুমোদন হলেই কাজ শুরু হবে।
জেলা প্রশাসন জরুরি ভিত্তিতে ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার পাঁচ উপজেলায় পাঠিয়েছে। সেখানে খেজুর, চাল, তেলসহ বেশ কিছু খাবার রয়েছে।
সহকারী কমিশনার (ত্রাণ) নাজিয়া নওরীন বলেন, আমাদের জন্য ২৮০ মেট্রিক টন চাল, আর চার লাখ টাকার একটি বরাদ্দ হয়েছে, যা এখনো পৌঁছায়নি।
জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, তিন হাজার ১০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও বরাদ্দ করা হবে।
এদিকে সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীতেও পানি বাড়তে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে জেলার কাজিপুর ও এনায়েতপুরের জালালপুর এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাকির হোসেন জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধ হার্ড পয়েন্ট এলাকায় যমুনা নদীর পানি ১০ সেন্টিমিটার বেড়েছে। এখন বিপৎসীমার ১ দশমিক ৩৭ মিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে (বিপৎসীমা ১৩.৩৫ মিটার)। একই সঙ্গে কাজিপুর উপজেলার মেঘাই ঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি রেকর্ড করা হয় ১৩ দশমিক ৯৩ মিটার। ২৪ ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে বিপৎসীমার ১ দশমিক ৩২ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে (বিপৎসীমা ১৫.২৫ মিটার)।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, ভারতে অতি বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে তিস্তা নদীর পানি ব্যারাজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। এ কারণে যমুনায় পানি বাড়ছে। তবে বন্যার কোনো আশঙ্কা নেই। বৃষ্টি কমলেই পানি কমতে শুরু করবে।