সন্তান পরিপালনে দায়িত্বশীলতা

মাকসুদা আক্তার: ছেলে হোক আর মেয়েই হোক, সন্তান মা-বাবার কাছে সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব দান। সন্তানকে ঘিরে জন্ম নেয় বাবা-মায়ের শত আশা-আকাক্সক্ষা। সন্তান জন্মের পর হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে যে জীবনের পথচলা শুরু হয়, সে পথের দিশা পায় বাবা-মায়ের হাত ধরেই। এই সন্তানই সঠিকভাবে বড় হলে বাবা-মায়ের জীবন যেমন ধন্য হয়, তেমনি বিপথে গেলে বাবা-মায়ের চিন্তার অন্ত থাকে না। প্রতিটি ধর্মেই সন্তানকে সঠিকভাবে শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। সন্তানকে ঘিরে স্বপ্নগুলো যেন অঙ্কুরেই বিনষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে বাবা-মাকেই।

বাবা-মায়ের কাছে সন্তান সাত রাজার ধন। সন্তানের জন্যই তারা পরিশ্রম করেন। সন্তানকে সুখে রাখার উদ্দেশ্যে তাদের সব পরিকল্পনা। সন্তানের জন্য শুধু অর্থ উপার্জন করলেই হবে না, দরকার সঠিক প্যারেন্টিং। বর্তমানে আধুনিক সমাজে বাবা-মা উভয়েই চাকরিতে ব্যস্ত থাকে, সন্তানকে সময় দেয়ার সুযোগ পায় না। ফলে অনেক সময়ই সন্তান বখে যায়। এর ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য আছে কিছু নিয়মকানুন। ছোট থেকেই তাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া দরকার। এর জন্য দরকার অসীম ধৈর্য ও অক্লান্ত পরিশ্রম। সৃষ্টিকর্তা বাবা-মাকে সে ধৈর্য দিয়েই পাঠিয়েছেন। বাবা-মায়ের ধৈর্য ও শ্রম সন্তানের জীবনকে প্রভাবিত করে। প্যারেন্টিংয়ে যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবেÑ

ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শেখাতে হবে: সন্তানকে ছোট থেকেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে। কথা বলার সময় তাদের ‘না’ বলা যাবে না। হ্যাঁ-বোধক বাক্যের মাধ্যমে সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সন্তানের মানসিক গড়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পরে সে আত্মবিশ্বাসী হয়। আত্মবিশ্বাসী সন্তান জীবনে সফল হয় বেশি। তবে অতি আত্মবিশ্বাসী ভালো নয়, এদিকেও বাবা-মাকে নজর দিতে হবে।

বিনয়ী হতে শেখাতে হবে: সন্তানকে শেখাতে হবেÑঅনুরোধ করা, ধন্যবাদ বলা, দুঃখিত বলা, এক্সকিউজ মি বলা শব্দগুলো। এগুলো বিনয়ী বাক্য। তাকে শেখাতে হবে সরি বা প্লিজ বললেই কেউ ছোট হয়ে যায় না। এগুলো বাবা-মায়ের দৈনন্দিন প্রয়োজনে বলা উচিত। বাবা-মায়ের বলা দৈনন্দিন কথাগুলো সন্তান অনুসরণ করে সবচেয়ে বেশি।

সন্তানের কথায় মনোযোগ দিতে হবে: সন্তান যখন কথা বলা শিখবে, তখন থেকেই তার কথায় মনোযোগ দিতে হবে। সে কী বলতে চায় তা শুনতে হবে। আবার অন্যরা কথা বলার সময় চুপ থাকতে হয় এবং মনোযোগী শ্রোতা হতে হবে, এটা সে আপনার কাছেই শিখবে। আপনি আপনার সন্তানের সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করবেন, সেও ঠিক তেমনটাই করবে।

দৈহিক আকৃতি বা রং নিয়ে মন্তব্য না করা: দৈহিক আকৃতি নিয়ে কু-মন্তব্য করা কখনোই ভালো ব্যক্তিত্বের লক্ষণ নয়। সব মানুষই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। তাই কানা হোক, খোঁড়া হোক, তাকে নিয়ে কু-মন্তব্য করা যাবে না। উল্টো তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক বন্ধুত্ব করা শেখাতে হবে। প্রয়োজনে সাহায্য করতে হবে। বাবা-মায়ের উচিত সন্তানকে এ বিষয়ে আগেই শেখানো। কাউকে নিয়ে অহেতুক মজা করা যাবে না।

কোথাও প্রবেশের ক্ষেত্রে অনুমতি নেয়া: যেকোনো ব্যাপারেই অনুমতি নেয়া শেখানো বাঞ্ছনীয়। কারও বাসায় প্রবেশের ক্ষেত্রে অনুমতি নেয়া শেখাতে হবে। এমনকি বাবা-মায়ের শয়নকক্ষে প্রবেশের ক্ষেত্রে নক করা শেখাতে হবে। শিক্ষকদের কক্ষে অথবা শ্রেণিকক্ষে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করার ক্ষেত্রে ‘না’ করতে হবে। অনুমতি ছাড়া কারও কোনো জিনিসে হাত না দেয়াও একটা গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার।

বাজে বা অশ্লীল ভাষা এড়িয়ে চলা: বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মানুষ বাজে বা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে থাকে। আবার টিভিতে দেখেও সন্তান এসব শিখতে পারে। তাই আগে থেকেই সন্তানের চলাচলে খেয়াল রাখতে হবে এবং বাজে ভাষা ব্যবহারকারী থেকে দূরে রাখতে হবে। সন্তানকে শেখাতে হবেÑকোনটা ভালো কথা, আর কোনটা বাজে কথা। ছোট থেকেই সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, তার ব্যবহার কী রকম এবং তার মুখ থেকে উচ্চারিত শব্দগুলোর প্রতিও খেয়াল রাখতে হবে।

সাহায্য করা শেখানো: কেউ বিপদে পড়লে হাত গুটিয়ে না নিয়ে সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে দিতে হবে। সন্তানকে শেখাতে হবে বিপদের ভয়ে পিছিয়ে গেলে হবে না। দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বাবা-মায়ের জন্যই সন্তান আত্মবিশ্বাসী হয়। আর যে সন্তানের আত্মবিশ্বাস রয়েছে, সে সব বিপদেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।

ধর্মে অনুরাগী করা: প্রত্যেক ধর্মেই রয়েছে আদর্শ জীবন পদ্ধতি, যা মেনে চললে মানুষ বিপথগামী হয় না। সন্তানকে নিজ নিজ ধর্মের প্রতি ছোট থেকেই অনুরাগ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে বাবা-মাকে। বাবা-মায়ের ধর্মের প্রতি টান থাকলে দেখা যায় পরবর্তী সময়ে সন্তানও ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়। এ থেকে সন্তানের নৈতিক জীবনের প্রতি আগ্রহ বাড়ে।

তথ্যপ্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব থেকে দূরে রাখতে হবে: বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে শিশুর বাইরে বের হয়ে খেলা করার জায়গা দখল করেছে স্মার্টফোন। বাবা-মায়ের ব্যবহƒত জিনিসের প্রতি স্বভাবতই সন্তানের আকর্ষণ থাকে প্রবল। কখনও কখনও বাবা-মা নিজেই ফোন দেখিয়ে সন্তানকে খাওয়াতে চান। এর ফলে শারীরিক বা মানসিক দিক দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা তৈরি হতে পারে। প্রযুক্তি ব্যবহারে অধিক সতর্ক হতে হবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে সন্তানকে অপ্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক সামগ্রী থেকে দূরে রাখাই উত্তম। প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া। সন্তান ভবিষ্যতে সফল হবে, নাকি বিফল হবে, তার পুরোটাই নির্ভর করে সঠিক প্যারেন্টিংয়ের ওপর।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

aktermaksuda05@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০