বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ

ইসমাইল আলী: শুক্রবার মধ্যরাত থেকে দেশে বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। দেশের ইতিহাসে এটি ছিল দাম বৃদ্ধির সর্বোচ্চ পরিমাণ। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নিন্মমুখী। বর্তমানে তা পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিন্ম পর্যায়ে রয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে শুক্রবার রাতে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৩৪ টাকা, অকটেন ৪৬ টাকা ও পেট্রোল ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে।

দাম বাড়ার পর প্রতি লিটার ডিজেল ১১৪ টাকা, কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫ টাকা ও পেট্রোল ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে ভোক্তা পর্যায়ে দাম ছিল প্রতি লিটার ডিজেল ৮০ টাকা, কেরোসিন ৮০ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা ও পেট্রোল ৮৬ টাকা। অর্থাৎ কেরোসিন ও ডিজেলের দাম বেড়েছে লিটারে ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ, পেট্রোলের ৫১ দশমিক ১৬ শতাংশ ও অকটেনের ৫১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

সর্বশেষ এ দাম বৃদ্ধির পর বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বর্তমানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে ছাড়িয়ে গেছে। গ্লোবাল পেট্রোল প্রাইসেস ডটকম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে নিয়মিত রিপোর্ট করে থাকে। ওয়েব সাইটটির গত ১ আগস্টের সর্বশেষ প্রতিবেদন ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের জ্বালানি তেল সরবরহকারী সংস্থাগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে শেয়ার বিজ তা তুলে এনেছে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে ভিন্ন ভিন্ন দামে জ্বালানি তেল বিক্রি করা হয়। এক্ষেত্রে দাম বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশটির দিল্লিতে বর্তমানে পেট্রোলের দাম লিটারপ্রতি ৯৬ দশমিক ৭২ রুপি বা ১১৫ টাকা ৯৭ পয়সা ও ডিজেল ৮৯ দশমিক ৬২ রুপি বা ১০৭ দশমিক ৪৬ টাকা। আর কলকাতায় পেট্রোল প্রতি লিটার ১০৬ দশমিক ০৩ রুপি বা ১২৭ দশমিক ১৪ টাকা এবং ডিজেল ৯২ দশমিক ৭৬ রুপি বা ১১১ টাকা ২২ পয়সা।

দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তানে বর্তমানে প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম ২২৭ দশমিক ১৯ পাকিস্তানি রুপি বা ৯৬ দশমিক ১৯ টাকা ও ডিজেলের দাম ২৪৪ দশমিক ৯৫ পাকিস্তানি রুপি বা ১০৩ টাকা ৭১ পয়সা। এদিকে অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কায় গত সপ্তাহে কমানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। এ সময় দেশটির পেট্রোলের (৯২ অকটেন) দাম কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫০ শ্রীলঙ্কান রুপি বা ১১৮ টাকা ৩৫ পয়সা। আর অটো ডিজেলের দাম কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৩০ রুপি বা ১১৩ টাকা ০৯ পয়সা।

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপেও জ্বালানি তেলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম। বর্তমানে দেশটিতে পেট্রোলের দাম প্রতি লিটার ১৬ দশমিক ৫৫ রুপাইয়া বা ১০২ টাকা ৬১ পয়সা এবং ডিজেল ১৬ দশমিক ৭৭ রুপাইয়া বা ১০৩ টাকা ৯৮ পয়সা। আর দক্ষিণ এশিয়ার আরেক রাষ্ট্র আফগানিস্তানেও জ্বালানি তেলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম। বর্তমানে দেশটিতে পেট্রোলের দাম প্রতি লিটার ৮৮ আফগানিতে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম পড়ছে ৯২ টাকা চার পয়সা। আর ডিজেল প্রতি লিটার ১১৮ আফগানি বা ১২৩ টাকা ৪১ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু নেপালে জ্বালানি তেলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে কিছুটা বেশি। দেশটিতে বর্তমানে প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম ১৮১ নেপালিজ রুপি বা ১৩৫ টাকা ৩৬ পয়সা ও ডিজেল ১৭২ রুপি বা ১২৮ টাকা ৬৩ পয়সা। অপরদিকে ভুটানে পেট্রোলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম তবে ডিজেলের দাম বেশি। দেশটিতে বর্তমানে পেট্রোলের দাম প্রতি লিটার ১০০ দশমিক ৫২ রুপি বা ১২০ টাকা ২৭ পয়সা এবং ডিজেলের দাম ১২০ দশমিক ৬৮ রুপি বা ১৪৪ টাকা ৩৯ পয়সা।

এদিকে ইউক্রেন-রশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ক্রমেই বাড়তে শুরু করলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা কমতে শুরু করেছে। গত জুলাইয়ে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়তে বাড়তে ব্যারেল উঠে যায় ১৩৯ ডলারে। তবে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই কমছে জ্বালানি তেলের দাম। গতকাল আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ৯০ ডলারেরও নিচে নেমে এসেছে, যা গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিন্ম। 

অয়েল প্রাইস ডটকম বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দুই ধরনের অপরিশোধিত তেলই এখন ১০০ ডলারের কমে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট অপরিশোধিত তেল (ক্রুড অয়েল) গতকাল প্রতি ব্যারেল ৮৮ ডলার ৪৩ সেন্টে বিক্রি হয়েছে। অপরদিকে ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেল বিক্রি হয়েছে ৯৩ ডলার ৯৫ সেন্টে।

ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের পর এবারই সবচেয়ে দ্রুত তেলের দাম কমছে। গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিন্ম পর্যায়ে নেমে আসছে জ্বালানি তেলের দাম। ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের দাম এক সপ্তাহেই কমেছে ১০ শতাংশ।

এদিকে লিবিয়া থেকে তেলের সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া চীনে অর্থনৈতিক কার্যক্রম হ্রাস পেয়েছে। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক দেশটির আমদানিও হ্রাস পেয়েছে।

যদিও বেশ কিছুদিন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলে ১১০ থেকে ১১৫ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছিল। মাস দুয়েক আগে দুই ধরনের তেলের দামই বেড়ে প্রতি ব্যারেল প্রায় ১২৫ ডলারে উঠেছিল। তবে কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার শঙ্কায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অল্প অল্প করে কমতে থাকে। এবার সেটি প্রায় (রাশিয়া-ইউক্রেন) যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ের কাছাকাছি নেমে এসেছে।

এমন সময়ে বাড়ানো হলো বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন ১৭৩ ডলার ছিল, তখন যদি দাম বাড়াতে হতো তাহলে লিটারপ্রতি ৮০ টাকা বাড়াতে হতো। আমরা তারপরও লোকসান দিয়ে গেছি। কারণ আমরা বাজার পর্যবেক্ষণ করছিলাম, আমরা দেখতে চাচ্ছিলাম আমরা নিজেদের অর্থ কতটুকু খরচ করতে পারি। কিন্তু এখন বিপিসির পক্ষে আর লোকসান টানা সম্ভব নয়। আট হাজার কোটি টাকার ওপরে লোকসান হয়েছে। এখন তেল সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে দাম বাড়ানোর বিকল্প ছিল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘উপায় না পেয়েই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া আমাদের আর কিছু করার ছিল না। বিশ্ববাজারের প্রেক্ষাপটে আমরা বাড়তি কিছু করিনি। আর বিশ্ববাজারে যদি দাম কমে আসে, তাহলে আমরা দাম আবার সমন্বয় করব।’

যদিও বাস্তবে দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও খুব একটা সমন্বয় করা হয় না। গত এক দশকের জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির চিত্র বিশ্লেষণ করলে এমনটি দেখা যায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে ২০০৮ সালের ২২ ডিসেম্বর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সে সময় প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৪৬ টাকা, পেট্রোল ৭৪ টাকা ও অকটেন ৭৭ টাকা।

এর পর ২০১১ সালে তিন দফা বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। এতে ২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রতি লিটার ডিজেলের দাম পড়ে ৬১ টাকা, পেট্রোল ৯১ টাকা ও অকটেন ৯৬ টাকা। ২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি তা আরও বেড়ে হয় যথাক্রমে ৬৮ টাকা, ৯৬ টাকা ও ৯৯ টাকা। ২০১৪ সালের পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করে। একসময় দাম অনেকটা কমলে সমালোচনার মুখে ২০১৬ সালে একবার দাম কিছুটা কমানো হয়েছিল। সে বছর ২৫ এপ্রিল প্রতি লিটার ডিজেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৬৫ টাকা, পেট্রোল ৮৬ টাকা ও অকটেন ৮৯ টাকা।

করোনাকালে জ্বালানি তেলের দাম ইতিহাসের সর্বনিন্ম পর্যায়ে নেমে যায়। এর পরও দেশে তেলের দাম কমানো হয়নি। বরং ২০২০-২১ অর্থবছর বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) রেকর্ড ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে গত ৪ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক দফা বাড়ানো হয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০