ইসমাইল আলী: ঢাকা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে গত বছর আহ্বান করা হয় ইওআই বা প্রাথমিক দরপত্র। এতে ছয়টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও মূল্যায়ন শেষে বাছাই করা হয় ব্রিটেনের ডিপি রেলকে। যদিও প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে কার্যক্রমহীন বা ডরমেন্ট অবস্থায় আছে। এছাড়া রেলপথ নির্মাণে অর্থনৈতিক বা কারিগরি যোগ্যতার কোনো প্রমাণ জমা দিতে পারেনি ডিপি রেল। তাছাড়া এরই মধ্যে দুই দফা পার্টনার বা সহযোগী সংস্থা পরিবর্তন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এরপরও ঢাকা-পায়রা বন্দর রেলপথ নির্মাণে ডিপি রেলের সঙ্গে গত ২০ ডিসেম্বর সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এটি নির্মাণে ব্যয়
ধরা হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, ঢাকা-পায়রা বন্দর মূল্যায়নে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয় পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে। বাকি সদস্যদের মধ্যে আরও তিনজন পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের ও দুজন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের। বাইরের সদস্য হিসেবে একমাত্র ছিলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) যুগ্ম সচিব। তবে ইওআই মূল্যায়ন শেষে ডিপি রেলকে কাজ দেওয়ার সুপারিশে ইআরডির যুগ্ম সচিব অজ্ঞাত কারণে সই করেননি।
দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, চারটি যোগ্যতার ভিত্তিতে ইওআইতে অংশ নেওয়া কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব বাছাই করা হয়। এগুলো হলোÑঅর্থনৈতিক ও কারিগরি সক্ষমতা, কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার, একই ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা ও কাজ করার মতো অভিজ্ঞ জনবল।
যদিও এ চারটি যোগ্যতাতেই ব্যর্থ ডিপি রেল। তথ্যমতে, ঢাকা-পায়রা রেলপথ নির্মাণের লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠা ব্রিটেনের ডিপি রেলের। প্রতিষ্ঠানটির জনবল মাত্র ১১। আর পরিশোধিত মূলধন ১০০ পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ১০ হাজার টাকার কোম্পানি পেতে যাচ্ছে ৬০ হাজার কোটি টাকার কাজ। এছাড়া রেলপথ নির্মাণের কোনো অভিজ্ঞতাও এখন পর্যন্ত নেই ডিপি রেলের। এমনকি ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো ধরনের কাজই করেনি নামসর্বস্ব এ প্রতিষ্ঠানটি। এরপরও ডিপি রেলের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের সুপারিশ করে মূল্যায়ন কমিটি।
মূল্যায়ন প্রতিবেদনের তথ্যমতে, পটুয়াখালীর রামনাবাদ চ্যানেলে ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠা করা হয়। বন্দরটিতে বছরে ৩০ লাখ টিইইউস কনটেইনার, ৪০ লাখ টন কয়লা ও অন্যান্য কার্গো হ্যান্ডল করা হবে। এসব পণ্য নৌপথের পাশাপাশি সড়ক ও রেলপথে পরিবহন করা হবে। এজন্য ঢাকা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে ইওআই আহ্বান করলে ছয়টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এগুলো হলোÑচীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন ও চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন, ব্রিটেনের ডিপি রেল, ভারতের ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল প্রাইভেট লিমিটেড ও শাপুরঝি পালোনঝি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড এবং হংকংয়ের রিনিয়েবল এনার্জিস ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আহ্বান করা হয়।
সিনোহাইড্রো করপোরেশন সম্পর্কে মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটির সরকারি সেবা প্রদানে ৬০ বছরের সফল ইতিহাস রয়েছে। নৌপরিবহন, বিদ্যুৎ, পুরকৌশল, অবকাঠামো, খনিজ ও পরিবেশগত প্রকৌশল খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। এছাড়া চীন ও বাইরে অর্থায়ন, ডিজাইন, নির্মাণ ও পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটি সক্ষম। সিনোহাইড্রোর বাস্তবায়িত বেশ কয়েকটি প্রকল্পের তালিকাও যুক্ত করা হয় প্রতিবেদনে। তবে এফডিআইয়ের পরিবর্তে জিটুজি ভিত্তিতে প্রস্তাব করে সিনোহাইড্রো।
ডিপি রেল সম্পর্কে মূল্যায়ন প্রতিবেদনে জানানো হয়, স্পেশাল পারপোস ভেহিক্যাল (এসভিপি) হিসেবে ডিপি রেল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যার বিশ্বমানের কিছু অংশীদার রয়েছে। এরা প্রস্তাবিত ডিজাইন, অর্থায়ন, নির্মাণ ও পরিচালনায় প্রক্রিয়া রেলপথ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সক্ষম। এদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বে রেলপথ নির্মাণে অন্যতম।
রেলপথটির নকশা প্রণয়নে সহায়তা করবে ব্রিটেনের রেন্ডাল। আর রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালট্যান্টস অব গ্লাসগো জমির গুণাগুণ পরীক্ষার কাজ করবে। রেলপথটি নির্মাণে সহায়তা করবে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। আর লুক্সেমবার্গের ব্রুশ ট্রাকশন ইঞ্জিন সরবরাহ করবে। আর ইওআইয়ের শর্তানুসারে এফডিআই ভিত্তিতে রেলপথ নির্মাণে আগ্রহী ডিপি রেল।
এদিকে চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের রেলপথ নির্মাণে অভিজ্ঞতা নেই। এছাড়া জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বাকি তিন প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল প্রাইভেট লিমিটেড, রিনিয়েবল এনার্জিস ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ও শাপুরঝি পালনঝি কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড দরপত্র জমা দিলেও বিস্তারিত কোনো তথ্য দেয়নি। তাই এদের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি মূল্যায়ন কমিটি।
প্রতিবেদনের মন্তব্য অংশে বলা হয়, সমর্ধমী প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে অভিজ্ঞ কোম্পানিকে ঢাকা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা উচিত। তবে প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি হবে এফডিআইয়ের ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে ছয়টি কোম্পানি ইওআইতে অংশ নিলেও রেলপথ নির্মাণে অভিজ্ঞ সিনোহাইড্রো ও ডিপি রেল। এদের মধ্যে ডিপি রেল কারিগরি ও আর্থিক দিক বিবেচনায় ডিপি রেল এগিয়ে আছে। তাই ডিপি রেলের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করা যেতে পারে।
গত ২১ জানুয়ারি এ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে সই করে কমিটির সদস্যরা। তবে বাইরে সদস্য হিসেবে থাকা ইআরডির প্রতিনিধি সই করেননি। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এছাড়া প্রকল্পটি বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওই সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতেই সম্প্রতি ডিপি রেলের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করা হয়।
বিষয়টি জানতে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, এত বড় প্রকল্প আনকোরা কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করানোর প্রশ্নই আসে না। আমার বিশ্বাস, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ডিপি রেলের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা যাচাই-বাছাই করেই সমঝোতা চুক্তি করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্ব^র লন্ডনে কোম্পানিজ হাউজে লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয় ঢাকা-পায়রা রেল লিমিটেড (ডিপি রেল), যার নিবন্ধন নম্বর ০৮৮২০৯৭৩। কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের মূল্য দশমিক শূন্য এক পাউন্ড বা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক টাকার সমান। মোট ১১ জনবলের মধ্যে একজন কোম্পানি সচিব হিসেবে নিযুক্ত। বাকিরা সবাই পরিচালক। তাদের বেশিরভাগেরই নিয়োগ ২০১৬ সালের ২ এপ্রিল ও তার পরে।
পরিচালকদের মধ্যে আনিসুজ্জামান চৌধুরী নামে একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতও রয়েছেন। অন্যরা ব্রিটিশ নাগরিক। তারা হলেন চার্লস ককবার্ন, পিটার আইলস, ইয়ান ডার্বিশায়ার, ম্যাট স্টেইনার, ডরিয়ান বেকার, বিল রবার্টস, জুলিয়ান লিন্ডফিল্ড, টিম মিডোস স্মিথ, গ্রাহাম লরেন্স ও পল টুইডাল। এদের কারোরই ভালো কোনো ব্যবসায়িক বা পেশাদারি প্রোফাইল নেই।
তিন বছর বয়সী ডিপি রেলের ব্রিটেনে কোনো কর্মকাণ্ড নেই। প্রতিষ্ঠানটিকে তাই কার্যক্রমহীন বা ডরম্যান্ট কোম্পানি হিসেবে মূল্যায়ন করেছে ব্রিটেনভিত্তিক ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠান এনডোলে। তারা বলছে, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকদের মধ্যে পাঁচজন সক্রিয়। এছাড়া একজন সক্রিয় কোম্পানি সচিব রয়েছেন। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ডিপি রেলের আর্থিক বিবরণীতে দেখা গেছে, এ দুই বছরই কোম্পানির মূলধন ১০০ পাউন্ডে অপরিবর্তিত রয়েছে।
একই ধরনের তথ্য মেলে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্রিটেনের কোম্পানি হাউজে জমা দেওয়া ডিপি রেল লিমিটেডের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকেও। সে প্রতিবেদন অনুযায়ী, এটি একটি ক্ষুদ্র কোম্পানি। এর মূলধন মাত্র ১০০ পাউন্ড। আর এ কোম্পানিটি জšে§র পর থেকে কোনো কাজ করেনি, ডরমেন্ট অবস্থায় ছিল এবং এর ১০০ পাউন্ডের মূলধন এক পেনি বা এক টাকা মূল্যের ১০ হাজার শেয়ারে বিভক্ত।
প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ঢাকা-পায়রা রেলপথ ছাড়া কোনো প্রকল্পের উল্লেখ নেই। কোনো ধরনের সম্পদ, মূলধন বা অর্থায়ন সম্পর্কিত কোনো ঘোষণাও নেই। যদিও ডিপি রেলের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, ৭৫০ কোটি ডলার বা প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির নকশা প্রণয়ন, অর্থায়ন, লাইন নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে ডিপি রেল। আর নির্মাণকাজে সহযোগিতা করবে চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিআরসি)। যদিও ইওআইতে সিআরসির কোনো তথ্য উল্লেখ ছিল না।
জানতে চাইলে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, মূল্যায়ন কমিটি প্রকল্পের কাজ শুধু ডিপি রেলের যোগ্যতার ভিত্তিতে সুপারিশ করেনি। বরং তাদের সঙ্গে রয়েছে রেললাইন নির্মাণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান চীনের সিআরসি। মূলত তারাই (সিআরসি) নির্মাণকাজ করবে। অর্থ ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে ডিপি রেল।
Add Comment