আতাউর রহমান: দেশের পুঁজিবাজারের পালে বইছে সূচকÑলেনদেন বৃদ্ধির হাওয়া। চলতি বছরের জুন ও জুলাই মাসে বাজার কিছুটা টাল-মাটাল হওয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দেয়ার পর আগস্টের শুরু থেকে উত্থানের ধারায় ফিরে পুঁজিবাজার। এতে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বড় উত্থান দেখা যায় বাজারে। পরের সপ্তাহে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে পতন হলেও, পরের সপ্তাহে আবার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠনের বিনিয়োগ সীমা শেয়ার ক্রয়মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে উত্থানে ফিরে বাজার। এর মাধ্যমে উত্থান অব্যাহত রেখে আগস্ট মাস শেষ করে পুঁজিবাজার।
এতে পুঁজিবাজারের সূচক বৃদ্ধির পাশাপাশি লেনদেনও দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর কারণ হিসেবে বাজার-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কেউ বলছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ছে। আবার কেউ বলছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়লেও সেটি কোনো কারসাজির অংশ হিসেবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠান ছাড়াও কিছু ব্যক্তি বিনিয়োগও রয়েছে। যারা কি না একসঙ্গে বাজারে ফ্লোর প্রাইস থাকার সুযোগ নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে যেসব শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে রয়েছে সেগুলোর মধ্য থেকে, সেই সঙ্গে স্বল্প পরিশোধিত মূলধনের এবং দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়িয়ে কম সময়ে মুনাফা করার জন্য কারসাজি করছে। তাই বাজারে ভালো মৌলভিত্তিক কোম্পানিতে সূচক ও লেনদেন বৃদ্ধির প্রভাব নেই।
এদিকে যখন বাজার থেকে শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস উঠে যাবে তখন কারসাজি শেষে কোম্পানিগুলো তাদের আসল দামে ফিরে যেতে শুরু করবে। তখন বাজারে আবারও বড় পতন ঘটবে বলে আশঙ্কা করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। এতে আতঙ্কিত হয়ে সবাই শেয়ার বিক্রি করে দিতে শুরু করলে সেল প্রেসার তৈরি হবে এবং বাজারে বড় পতন হতে পারে। সেটা যেন ৯৬ বা ২০১০ সালের মতো না হয় সেই ভয় করছেন সংশ্লিষ্ট সবাই। তাই বাজারের এই ভালো পরিস্থিতি সব সময় না থাকলেও যেন বড় কোনো পতন না হয়. সেজন্য মার্কেট মেকার ও বাইব্যাক আইন কার্যক্রমের দাবি তুলেছেন তারা। বাইব্যাক আইন চালু হলে বাজারে আস্থা বাড়বে, সেই সঙ্গে সেল প্রেসার ও বড় পতন থেকে মার্কেট মেকার বাজারকে রক্ষা রাখবে বলে জানান।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয়েছে বাজারে লেনদেনের গড় দামের ওপর ভিত্তি করে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের আগে বেশ কিছু শেয়ার যৌক্তিক দামের থেকে বেশি ছিল। এর ফলে সেসব শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস এখনও যৌক্তিক দামের থেকে বেশি। এদিকে বাজার এখন ভালো অবস্থানে থাকার বড় একটি কারণ হচ্ছে সবাই শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস দেখে বিনিয়োগ করছে। এতে শেয়ারের আসল মূল্য অনেকেই এখন লক্ষ্য না করে দাম বাড়তে দেখে বিনিয়োগ করছে এবং হিসেবে রাখছে শেয়ারটির দাম কমলেও একটি নির্দিষ্ট দামের নিচে যাবে না। কিন্তু যখন ফ্লোর প্রাইস উঠে যাবে তখন শেয়ারের দাম তার যৌক্তিক দামে ফিরে যেতে শুরু করবে। এতে যেসব শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস যৌক্তিক দামের থেকেও বেশি সেগুলো যখন ফ্লোর প্রাইসে নিচে নামবে তখন বিনিয়োগকারী আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে থাকবে। এর ফলে বাজারে সেল প্রেসার তৈরি হবে এবং বড় পতনের সম্মুখীন হতে পারে বলে জানান তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলেও বাজার যাতে আর কোনো বড় পতনের সম্মুখীন না হয়। ৯৬ ও ২০১০ এর পতনের পুনরুত্থান যেন ফিরে না আসে সেজন্য এখনই মার্কেট মেকারের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। যাতে ফ্লোর প্রাইস ওঠার পরে যেসব শেয়ার দর কমতে শুরু করবে এবং বিনিয়োগকারী আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি শুরু করলে, তখন মার্কেট মেকার তার ভূমিকা পালন করে বাজারকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করবে। সেই সঙ্গে যদি বাই ব্যাক আইনটি চালু করা যায়, তাহলে বাজারে আস্থা বজায় থাকবে বলেও জানান তারা।
এ বিষয়ে এনসিসিবি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মনজুরুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ফ্লোর প্রাইস এখন একটি আস্থা হিসেবে কাজ করছে। যার ফলে অনেকে ফ্লোর প্রাইস দেখে বিনিয়োগ করছে যে শেয়ারের দর এর নিচে নামবে না। তাই ফ্লোর প্রাইস আপাতত তুলে দেয়া ঠিক হবে না তাহলে বাজারে আতঙ্কিত হয়ে পতন দেখা দিবে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ফ্লোর প্রাইস চায় না, তারা চায় সবচেয়ে কম দামে শেয়ার কিনতে। কিন্তু আমাদের বাজারে জেনারেল বিনিয়োগকারী বেশি, তাই ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে অর্থনীতি অবস্থা খারাপ আর শেয়ারের দাম কমার শঙ্কা নিয়ে বাজারে পতন হবে।
তিনি বলেন, কোম্পানি বাইব্যাক আইন চালু হলে বাজারের জন্য অনেক ভালো হবে। এর কারণ হচ্ছে এখন যেসব কোম্পানি কারসাজি করে শেয়ারের দর অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে, তখন সেটা আর করতে পারবে না। কারণ তারা কারসাজি করে শেয়ার দর বাড়ানোর পর যখন আবার কমে যাবে তখন তাদেরকেই সেগুলো কিনতে হবে। আবার যেসব কোম্পানি শেয়ার ছেড়ে টাকা তুলে নিয়ে পড়ে কোম্পানি বিক্রি করে দিয়ে চলে যায় তারা সেটা করতে পারবে না। এতে বাজারে কোম্পানির কারসাজি বন্ধ হবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। তবে এর আগে ২ শতাংশ ও ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে পালন নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, মার্কেট মেকার হতে হবে ডিএসই, সিএসই, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং সিএমএসএফসহ যাদের ফান্ড আছে তাদের। কোনো ব্রোকারেজ হাউসকে নয়, ব্রোকারেজ হাইস হলেও সে কোনো কাজে আসবে না। বরং ডিএসই, সিএসই এবং যাদের কাছে অর্থ পড়ে আছে, সচারচর ফান্ড থাকে বা এফডিআর করে রেখেছে তাদের মার্কেট মেকারের ভূমিকা পালন করতে হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, যখন বাজার খারাপ অবস্থায় ছিল তখন আমরা ফ্লোর প্রাইসের দাবি তুলি এবং আন্দোলনের মাধ্যমে সেটা কার্যকর করাই। বিএসইসির চেয়ারম্যান ফ্লোর প্রাইস দিতে একেবারেই নারাজ ছিলেন। কিন্তু আমরা যখন জোর দিলাম এবং বাজারের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে থাকল তখন বাধ্য হয়ে তিনি ফ্লোর প্রাইস দেন। ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর বাজার ভালো অবস্থানের দিকে ফিরতে শুরু করল। কিন্তু দেখা গেল অনেক শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস তাদের যৌক্তিক দামের থেকে বেশি। তাই যখন ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়া হবে তখন বিনিয়োগকারীদের মাঝে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে এবং বাজারে আবার পতন দেখা দেবে। এজন্য এখনই ফ্লোর প্রাইস তোলার জন্য দাবি জানাচ্ছি। ফ্লোর প্রাইস যেন বাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত তোলা না হয়, সেটা অত্যন্ত দুই বছরের জন্য রাখা হোক।
তিনি আরও বলেন, সেই সঙ্গে বছরে আইপিও সংখ্যা কমিয়ে দিতে হবে। বছরে দুই-পাঁচটার বেশি আইপিও না দেয়া ভালো। সেটা যেন ১০-২০ না হয় বছরে। সেই সঙ্গে কোম্পানি বাইব্যাক আইনটা চালু করার দাবি তুলে তিনি জানান, এই আইনটা বাজারের ভালোর জন্য চালু করা খুবই জরুরি। সেটা সব শেয়ারের জন্য না হলেও আংশিক হতে পারে। এতে যে কোম্পানির শেয়ার দর কমতে শুরু করবে এবং কোম্পানি মনে করবে যৌক্তিক দামের থেকে কম গেছে তখন কোম্পানি কিনে নেবে। আবার যেসব কোম্পারি শেয়ার প্রিমিয়ামের বা ফেস ভ্যালুর নিচে যাবে তখন সেসব কোম্পানি শেয়ার কিনে নেবে। একই সঙ্গে মার্কেট মেকারের কার্যক্রম দ্রুত শুরু করতে হবে, তাহলে বাজার স্থিতিশীল থাকবে বলে জানান তিনি।