রাজস্ব ফাঁকিতে বহুজাতিক পারফেট্টি ভ্যান মেলে

রহমত রহমান: সেন্টার ফ্রুট, সেন্টার ফ্রেশ, অ্যালপেনলিবে, মেনটস এবং চুপাচুপসের মতো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারক কোম্পানি পারফেট্টি ভ্যান মেলে বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড। ইতালীয় এ বহুজাতিক ক্যান্ডি ও চুইংগাম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শুল্ককর ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে অসত্য বা মিথ্যা এইচএস কোডে প্রতিষ্ঠানটি পণ্য খালাস নিয়েছে। বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়ে ৫৭টি চালানে অসত্য এইচএস কোড ব্যবহার করে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ কেজির বেশি পণ্য খালাস নেয়া হয়েছে, যাতে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটের নিরীক্ষায় এ ফাঁকি উঠে এসেছে। ফাঁকি দেয়া শুল্ককর আদায় ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বেনাপোল কাস্টম হাউসকে এরই মধ্যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

যদিও পারফেট্টি ভ্যান মেলে বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের কর্মকর্তা (অ্যাসোসিয়েট হেড করপোরেশন ফাইন্যান্স) মো. বখতিয়ার আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমাদের লিগ্যাল টিম কাজ করছে। তবে এটা ফাঁকি নয়। আমরা ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে গুডস রিসিভ করেছি। এ নিয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলা চলছে। পুরোনো কাহিনি।’

কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযোগ উঠে পারফেট্টি ভ্যান মেলে বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড অসত্য এইচএস কোডে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে পণ্য আমদানি ও খালাস নিচ্ছে। পারফেট্টি ভ্যান মেলে যে পণ্য ৩১ শতাংশ (টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্স বা টিটিআই) শুল্ককর দিয়ে খালাস নিয়েছে, একই পণ্য অন্য আমদানিকারক ৫৮ শতাংশ শুল্ককর দিয়ে খালাস নিয়েছে। অর্থাৎ পারফেট্টি ভ্যান মেলে যে এইচএস কোডে পণ্য খালাস নিয়েছে, তার টিটিআই বা মোট শুল্ককর ৩১ শতাংশ। আর অন্য আমদানিকারকরা একই পণ্য ৫৮ শতাংশ মোট শুল্ককর দিয়ে খালাস নিয়েছে। পারফেট্টি ভ্যান মেলের মতো একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান শুল্ককর ফাঁকি দিতে মিথ্যা বা অসত্য এইচএস কোডে পণ্য খালাস নিয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে কাস্টমস মূল্যায়নকে চিঠি দেয়া হয়।

সে অনুযায়ী অভিযোগ যাচাইয়ে প্রতিষ্ঠানটির আমদানি করা পণ্য খালাসোত্তর নিরীক্ষা বা পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট (পিসিএ) করার উদ্যোগ নেয়া হয়। চলতি বছরের ৬ জুন নিরীক্ষা দল গঠন করা হয়। নিরীক্ষা দল প্রতিষ্ঠানটির ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ২৫ মে পর্যন্ত ৩৬ মাসের প্রতিষ্ঠানের আমদানি ও খালাস নেয়া চালানের নিরীক্ষা করে। নিরীক্ষা দলের কর্মকর্তারা কাস্টমস মূল্যায়নের ‘ওরাল বিজনেস ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যার’ থেকে আইসিডি কমলাপুর কাস্টম হাউস দিয়ে প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা পণ্যের ডেটাবেজ পর্যালোচনা করেন, যাতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ৩৬ মাসে আইসিডি কমলাপুর কাস্টম হাউস দিয়ে ৫৭টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ছয় লাখ ৪৭ হাজার ৮২০ কেজি পণ্য আমদানি করেছে। আমদানি করা পণ্যের মধ্যে রয়েছেÑগাম বসে ব্লুপ ১৭/৩৩৯ বিবিটি, গাম বসে মার্টিন ১৭/০৪২ বিবিটি, গাম বসে ভিভি জিবিএস। এসব পণ্য ৪০০২.৩৯.০০ এইচএস কোডে শুল্কায়ন করে খালাস নেয়া হয়েছে। ৪০০২.৩৯.০০ এইচএস কোডে টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্স (টিটিআই) ৩১ শতাংশ (সিডি ৫ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর বা এআইটি ৫ শতাংশ ও আগাম কর বা এটি ৫ শতাংশ)। নিরীক্ষায় কর্মকর্তারা দেখতে পান, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি অসত্য বা মিথ্যা এইচএস কোডে পণ্য খালাস নিয়েছে।

খালাস নেয়া পণ্যের সঠিক এইচএস কোড হবে ৩৮২৪.৯৯.৯০। এই এইচএস কোডে টিটিআই হবে ৫৮ শতাংশ (সিডি ২৫ শতাংশ, এসডি বা নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, এআইটি ৫ শতাংশ ও এটি ৫ শতাংশ)। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর ফাঁকি দিতে মিথ্যা বা অসত্য এইচএস কোডে পণ্য শুল্কায়ন করে খালাস নিয়েছে। সঠিক এইচএস কোড অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা ছয় লাখ ৪৭ হাজার ৮২০ কেজি পণ্যে প্রতিষ্ঠানটি পাঁচ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার ৬৭২ টাকার শুল্ককর পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। এই এইচএস কোডে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এসব পণ্য শুল্কায়ন করে খালাস নিয়েছে বলে নিরীক্ষায় উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সঠিক এইচএস কোডে ফাঁকি দেয়া শুল্ককর কেন পরিশোধ করা হবে নাÑএ মর্মে প্রতিষ্ঠানকে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে ১৯ জুন অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো লিখিত জবাব দেয়া হয়নি এবং প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা কাস্টমস মূল্যায়নে যোগাযোগ করেনি। প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো জবাব না পাওয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে পাঠানো চিঠি ও নিরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে নিরীক্ষা দল মনে করে, পারফেট্টি ভ্যান মেলে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে অসত্য বা মিথ্যা এইচএস কোডে পণ্য শুল্কায়ন করেছে। ফাঁকি দেয়া পাঁচ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার ৬৭২ টাকার শুল্ককর আদায় ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চলতি বছরের ৩০ জুন বেনাপোল কাস্টম হাউস কমিশনারকে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, পারফেট্টি ভ্যান মেলে বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড ইউরোপীয় পারফেট্টি ভ্যান মেলে গ্রুপের একটি সম্পূর্ণ মালিকানাধীন সাবসিডিয়ারি হিসেবে ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ড হিসেবে বিশ্বে সেন্টার ফ্রুট, সেন্টার ফ্রেশ, এলপেনলিবে এবং মেনটস অত্যন্ত জনপ্রিয়, যা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে এর পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। আঞ্চলিক ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে এয়ার হেড, সেন্টার ফ্রুট, বিগ বাবল, গোলিয়া, স্মিন্ট, হ্যাপিডেন্ট অন্যতম। কোম্পানিটি ১৫০টির বেশি দেশে ব্যবসা করে আসছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০