রোহান রাজিব: দর বেঁধে দেয়ার পরও আমদানির ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তির (বিসি সেল) ক্ষেত্রে বেশি দামে ডলার বিক্রি করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। অধিকাংশ ব্যাংক নিজেদের ওয়েবসাইটে আমদানি দায় নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ডলারের দাম প্রদর্শন করছে ৯৫ টাকা পাঁচ পয়সা, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দামের কাছাকাছি। অথচ তারা এলসি নিষ্পত্তি করছে ১০০ থেকে ১০৬ টাকায়। গত মাসের শেষ সপ্তাহে বিভিন্ন ব্যাংকে এলসি নিষ্পত্তির তথ্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ওই দিনের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে এলসির বিপরীতে সবচেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে বেসরকারি খাতের এনসিসি ব্যাংক।
জানা যায়, বেসরকারি খাতের চারটি ব্যাংকে আগস্টের শেষ সপ্তাহের আমদানি এলসি নিষ্পত্তির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই দিন এক্সিম ব্যাংক আমদানিকারকদের কাছে প্রতি ডলারের দাম রেখেছে ১০০ টাকা। শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকে এ হার ছিল ১০৩ টাকা। ব্র্যাক ব্যাংকে ১০৫ টাকা ২৫ পয়সা এবং এনসিসি ব্যাংকে ১০৬ টাকা। চারটি ব্যাংকের মধ্যে আমদানি এলসিতে ডলারের সবচেয়ে বেশি দাম নিয়েছে এনসিসি ব্যাংক।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো আমদানি দায় নিষ্পত্তির (বিসি সেল) ক্ষেত্রে ডলারের একটা দাম ঘোষণা করেছে। কিন্তু নিজেদের ঘোষিত দামের চেয়ে কোনো কোনো ব্যাংক প্রায় ১০ টাকা বাড়তি দাম নিচ্ছে আমদানিকারকদের থেকে। নিজেদের ঘোষিত দাম নিজেরাই মানছে না। ফলে ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবতার মিল না থাকায় বিপাকে পড়ছেন আমদানিকারকরা।
আমদানির এলসি নিষ্পত্তিতে দাম বেশি নেয়ার ফলে দাম বেড়ে যাচ্ছে খাদ্যপণ্যের। এর ফলে চাপ বাড়ছে ভোক্তাপর্যায়ে। এছাড়া মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাচ্ছে। তবে সবাই যে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারছেন, তা নয়। বিশেষ করে ডলারের দাম বাড়ায় ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বেশ চাপে পড়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দর বেঁধে দিয়েছে ৯৫ টাকা। কিন্তু ব্যাংকগুলো তা মানছে না বলে অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ব্যাংকে এলসি নিষ্পত্তি করতে গেলে ডলারের বিপরীতে নেয়া হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৬ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু সরকারি জ্বালানি ও জরুরি খাদ্য আমদানির দায় মেটানোর ক্ষেত্রেই প্রতি ডলার ৯৫ টাকা দামে বিক্রি করছে, যা আগে ছিল ৮৬ টাকা।
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের চাপ সামলাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। আমদানির লাগাম টানতে মার্জিন বাড়ানো হয়েছে। অনেক পণ্য আমদানিতে ব্যাংক ঋণের সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আবার ব্যাংকগুলোকে ৩০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের ঋণপত্রের তথ্য ২৪ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে বলা হয়েছে। এসব ঋণপত্রের মূল্য খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে আমদানির চাপ অনেকটা কমেছে। গত জুনের তুলনায় জুলাইয়ে ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও নিষ্পত্তির হার কমেছে।
এদিকে ডলারে অতিরিক্ত মুনাফা করায় বাংলাদেশ ব্যাংক ছয়টি তফসিলি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে সম্প্রতি দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। ব্যাখ্যা দিতে এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদেরও (এমডি) নোটিশ দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো ক্ষমা চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়েছে।
ডলার মার্কেটের এ রকম পরিস্থিতিতে সংকট সামলাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তথা মজুত থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তথ্যমতে, গত বৃহস্পতিবারও কয়েকটি ব্যাংকের কাছে সাত কোটি ৬০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দুই মাস এক দিনে রিজার্ভ থেকে ২৫৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া গত অর্থবছর রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে ডলার বিক্রির চাপে গত রোববার দিন শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩৮ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এর আগে গত ১২ জুলাই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এরপর ২০ জুলাই পর্যন্ত রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৮০ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে। জুলাইয়ের শেষে তা কমে ৩৯ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।