হাজীগঞ্জে জৈব কৃষিতে সফল প্রবাসফেরত সুমন

বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর : প্রায় সাত লাখ টাকা খরচ করে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ২০১১ সালে প্রবাসে পাড়ি জমান। প্রবাসে গিয়ে ৯ বছরেও ভাগ্যের চাকা ঘোরেনি। হতাশ হয়ে ফিরে আসেন দেশে। আড্ডাবাজিতে না জড়িয়ে সারাদিন পড়ে থাকতেন মোবাইল নিয়ে। শাকসবজি চাষাবাদ সম্পর্কে ধারণা খুঁজতে থাকেন নেট দুনিয়ায়। সামান্যতম পড়াশোনালব্ধ জ্ঞানের আলোকে ভিন্ন কিছু করতে চেয়েছেন। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। রাসায়নিক চাষাবাদ আর ফরমালিন-মিশ্রিত খাদ্যের বিষাক্ততার ছোবল থেকে গাঁয়ের মানুষকে সরিয়ে আনার ক্ষুদ্র প্রয়াস নেন তিনি। অবশেষে নিজের জমিতেই শুরু করেন জৈব পদ্ধতিতে শাকসবজি চাষাবাদ। শাকসবজির চাষ করে চমকে দেন কৃষি বিভাগের বড় বড় কর্মকর্তাকে। অজপাড়াগাঁ থেকে বিষমুক্ত শাকসবজির চাহিদা বাড়তে থাকে গাঁয়ের হাটবাজারে। গাঁয়ের মানুষের কাছে তিনি এখন জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাসের পথপ্রদর্শক হিসেবেই পরিচিত।

এ তরুণ উদ্যোক্তার নাম সুমন দেবনাথ (৩৯)। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার গন্ধব্যপুর ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামের চিত্তরঞ্জন দেবনাথের ছেলে। সুমন দেবনাথের আগ্রহ ছিল গ্রামের মানুষের কল্যাণে কিছু করা। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচনার সময়ে দেশের মানুষের জন্য তা উৎপাদনের চিন্তা আসে তার মাথায়।

একদিকে চাষাবাদে বিষাক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে, অন্যদিকে খাদ্যে দেয়া হচ্ছে ফরমালিন। জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। বাড়ছে রোগব্যাধি। সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুমন দেবনাথের এই জৈব কৃষি পদ্ধতি আশার আলো দেখাচ্ছে। গ্রামীণ কৃষিতে ‘অরগানিক’ বা জৈব পদ্ধতির চাষাবাদ অনুসরণীয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে এ কৃষি পদ্ধতি এখন হাজীগঞ্জের গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদে তরুণদের পাশাপাশি কৃষকরাও উৎসাহিত হচ্ছেন, অনুসরণ করছেন সুমনকে। চাষাবাদের আদিম পদ্ধতি শিখে চেষ্টা করছেন নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার। জৈব কৃষিতে সুমনের সাফল্যের পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন হাজীগঞ্জ উপজেলার সাবেক কৃষি কর্মকর্তা মাজেদুর রহমান। সুমন বলেন, মাজেদুর রহমান স্যার আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন, যার কারণে আমি আজ জৈব কৃষিতে সফল মানুষ।

জৈব পদ্ধতির ব্যবহার করে  সুমন প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতে চাষ করছেন নবাব জাতের করলা, ময়না জাতের লাউ, বাহুবলি জাতের টমেটো, ঝিঙা, সাবিরা জাতের শসা, রকমেলন, চিচিঙ্গা ও ক্যাপসিকাম। এসব বিষমুক্ত শাকসবজি চাষ করে আশানুরূপ ফসল পেয়েছেন তিনি। ৩৫ শতাংশ জমিতে টমেটো চাষ করে প্রায় ৩০০ মণ টমেটো বিক্রি করেছেন। বাড়ির উঠানে প্রায় তিন শতাংশ জমিতে মাত্র এক হাজার টাকা খরচে লাউ চাষ করে ৫০ হাজার টাকার লাউ বিক্রি করেছেন। এখনও লাউ ঝুলছে সুমনের মাচায়। এছাড়া সুমন ভার্মি কম্পোস্ট সার নিজে তৈরি করে বিক্রি করছেন বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের মাঝে। প্রায় তিন একর এরিয়ায় আছে সুমনের মাছের প্রজেক্ট। মাত্র তিন বছরেই কঠোর পরিশ্রম করে সুমন বদলে নিয়েছেন নিজের জীবনের গতিপথ। সুমন এখন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী। সুমনের জৈব কৃষিতে সফলতা দেখে অনেক বেকার যুবক বিভিন্ন গ্রামে শুরু করেছেন জৈব পদ্ধতিতে শাকসবজি চাষাবাদ। সুমন এখন বেকার যুবকদের জৈব কৃষির পথপ্রদর্শক।

উদ্যোক্তা সুমনের মতে, রাসায়নিক সার দিয়ে চাষাবাদ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। খাদ্য উৎপাদন খরচও বেশি হয়। জৈব সার দিয়ে চাষাবাদ পরিবেশসম্মত এবং উৎপাদন খরচ কম হয়। উৎপাদিত খাদ্য স্বাস্থ্যসম্মত। এ কারণে এদিকে ঝোঁক রয়েছে অনেকের। জৈব কৃষিপ্রযুক্তির কাজে তার বাবা ও স্ত্রীকে সম্পৃক্ত করেন। রাসায়নিক সার, রাসায়নিক কীটনাশক, গ্রোথ হরমোনসহ যে কোনো রাসায়নিক পদ্ধতি ছাড়া জৈব সার ও জৈব কীটনাশক দিয়ে পরিবেশবান্ধব উপায়ে ফসল উৎপাদন করাই হচ্ছে অরগানিক ফার্মিং বা জৈব কৃষি।

জৈব কৃষি সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক অবসরপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা বলেন, সরকার ২০১৬ সালে ‘জৈব কৃষিনীতি’ অনুমোদন করেছে। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত ফসল উৎপাদনের কথা বিবেচনায় রেখে বর্তমান সরকার ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করেছে, যার ৫৮ ধারায় বলা আছে, ‘মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক দ্রব্য, কীটনাশক বা বালাইনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের জন্য পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০