ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতু নির্মাণব্যয় এখন পর্যন্ত ধরা আছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। তবে এ ব্যয় শিগগিরই বৃদ্ধি পাবে। দ্বিতল এ সেতুটির নিচতলা দিয়ে ট্রেন চলাচল করবে, যা আগামী বছর উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। এজন্য নির্মাণব্যয়ের প্রায় ১৭ শতাংশ রেলওয়ের কাছে দাবি করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)।
যদিও পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয়ের কোনো অংশ দিতে রাজি নয় রেলওয়ে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক হারে বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো টোল দিতে চায় সংস্থাটি। তবে একান্তই যদি নির্মাণব্যয়ের অংশ দিতে হয়, তবে টোল আয়ের অংশ দিতে হবে রেলওয়েকে। এক্ষেত্রে সেতুর পাশাপাশি রেলপথের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও টোল থেকেই দিতে হবে বিবিএকেÑএমনটাই দাবি করেছে সংস্থাটি।
সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে রেলওয়ে। শিগগিরই তা চিঠির মাধ্যমে বিবিএকে জানানো হবে।
এর আগে গত ২৪ এপ্রিল রেলওয়েকে চিঠি দিয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয় দাবি করে বিবিএ। এতে বলা হয়, পদ্মা সেতুর রেলওয়ে ডেক, ভায়াডাক্ট ইত্যাদি নির্মাণ বাবদ ঠিকাদারের বিল দিতে হয়েছে পাঁচ হাজার ১৮৩ কোটি ২২ লাখ টাকা, মোট ব্যয়ের তা ১৭ দশমিক ০২৫ শতাংশ। এ বিল বাবদ অর্থ বিভাগকে সুদসহ পরিশোধ করতে হবে ছয় হাজার ১৯৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর সঙ্গে রেল সংযোগের ডিজাইন বাবদ এডিবির (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) ঋণ ৪৭ লাখ ৮৪ হাজার ডলার। সুদসহ তা পরিশোধ করতে হবে ৫৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে রেলের অংশটির জন্য ছয় হাজার ২৫২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে বিবিএকে।
৩৫ বছরে ১৪০ কিস্তিতে তা পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া প্রতি ১০ বছর পরপর সেতুটির বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। সে খাতেও প্রচুর অর্থ ব্যয় হবে। তাই প্রতি বছর ট্রেন চলাচল বাবদ ব্যয় কিস্তিতে ঋণের অর্থ সুদসহ রেলওয়েকে পরিশোধ করতে হবে। এজন্য আগামী অর্থবছর পরিশোধ করতে হবে ১০৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। তবে প্রতি বছর এর পরিমাণ বাড়বে। এর মধ্যে ২০৪৭-৪৮ অর্থবছর সর্বোচ্চ ২৫১ কোটি ১১ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে।
যদিও বিবিএর এ দাবিকে অযৌক্তিক বলে মনে করছে রেলওয়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত জুনে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয় পরিশোধ বাবদ বিবিএর সঙ্গে অর্থ বিভাগের চুক্তির কপি, পদ্মা সেতুতে ৩৫ বছরে টোল আদায়ের সম্ভাব্য পরিমাণ, সেতুটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, বঙ্গবন্ধু সেতু ট্রেন চলাচল বাবদ বর্তমানে পরিশোধিত টোল প্রভৃতি বিবেচনায় তিনটি সুপারিশ তুলে ধরে।
এর মধ্যে প্রথম সুপারিশ হলো পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলাচলের জন্য প্রতি বছর এত বিশাল অঙ্কের অর্থ টোল হিসেবে দেয়া রেলের পক্ষে সম্ভব নয়। দ্বিতীয় সুপারিশ হলো বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেন চলাচলে বছরে টোল দিতে হয় বর্তমানে এক কোটি টাকা। গত নভেম্বর পর্যন্ত এ হার ছিল ৫০ লাখ টাকা। আর পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য বঙ্গবন্ধু সেতুর এক দশমিক ২৮ গুণ। তবে পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলবে বঙ্গবন্ধু সেতুর এক-তৃতীয়াংশ। তাই পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলাচলের জন্য রেলওয়ে বছরে এক কোটি থেকে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা টোল দিতে পারে।
কমিটির তৃতীয় সুপারিশটি হলো পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলাচলের জন্য যদি একান্তই নির্মাণব্যয়ের ১৭ শতাংশ অর্থ দিতে হয়, তবে তা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে রেলওয়েকে সরবরাহ করতে হবে। কারণ সেতুতে বছরে ৮-১০টি ট্রেন চলবে। আর এ ট্রেনগুলো থেকে ১০৭ থেকে ২৫১ কোটি টাকা টোল আহরণ করা রেলওয়ের পক্ষে অসম্ভব। তাই নির্মাণব্যয়ের অংশ দিতে হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। তবে নির্মাণব্যয়ের ১৭ শতাংশ দিলে বিবিএকে অবশ্যই রেলওয়ের সঙ্গে সেতুটি থেকে প্রাপ্ত আয়ের অংশ ভাগাভাগি করতে হবে। এক্ষেত্রে বছরে প্রাপ্ত মোট টোল আয় থেকে সব ধরনের খরচ বাদ দিতে হবে। এরপর সেতুর ওপরের তলার যানবাহন চলাচলের এবং নিচের তলার ট্রেন চলাচলের অংশের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহ করতে হবে। অতঃপর অবশিষ্ট আয় থেকে ১৭ শতাংশ অনুপাতে রেলওয়েকে আয়ের অংশ দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে কমিটির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখেছি ৩৫ বছরে পদ্মা সেতুর ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে। তবে সেতুটির আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ১০০ বছর। সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ করলে তা আরও বেশিদিন ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া প্রতি বছর সেতুটি থেকে আয় বাড়বে বলে প্রক্ষেপণ করেছে বিবিএ। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পাদিত ঋণ চুক্তিতে রেলের টোলের অংশ ধরা হয়নি। হঠাৎ করে এ অর্থ চাওয়া হচ্ছে।’
তারা আরও বলেন, ‘রেলওয়ে মনে করে নির্মাণব্যয় বহন করতে হলে তা হবে এক ধরনের বিনিয়োগ। আর বিনিয়োগ থেকে অবশ্যই রিটার্ন চায় সবাই। তাই পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয় বহন করলে অবশ্যই এর আয়ের অংশ পাওয়ার দাবিদার রেলওয়েও। এজন্য নির্মাণব্যয়ের অংশ বহন করলে মুনাফার ভাগও দিতে হবে।’
সূত্রমতে, পদ্মা সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দিয়েছে অর্থ বিভাগ। এ ঋণ পরিশোধে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট চুক্তি সই করে বিবিএ ও অর্থ বিভাগ। ঋণচুক্তি অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর থেকে ৩৫ বছরে এক শতাংশ সুদে অর্থ বিভাগের ঋণ পরিশোধ করা হবে। এতে সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে প্রায় ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। এর ভিত্তিতেই সেতুতে চলাচলে যানবাহনের টোলের হার ধার্য করা হয়েছে। তবে রেলের জন্য কোনো ধরনের টোল ধার্য করা ছিল না।
এদিকে উদ্বোধনের পর টোল বাবদ ৩৫ বছর (২০২২-২৩ থেকে ২০৫৬-২৭ অর্থবছর) পদ্মা সেতু থেকে বিবিএর সম্ভাব্য টোল আদায় হবে এক লাখ এক হাজার ৩২৪ কোটি ১২ লাখ টাকা। এর থেকে ভ্যাট-ট্যাক্স ও ঋণ পরিশোধ বাবদ অর্থ বিভাগ নিয়ে যাবে ৬৩ হাজার ২৪৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর সেতুটির রক্ষণাবেক্ষণে ৩৫ বছরে বিবিএর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৫৯৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এছাড়া অবচয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে ৩৫ বছর পর পদ্মা সেতু থেকে বিবিএর মুনাফা থাকবে মাত্র পাঁচ হাজার ৯৮৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তবে ৩৫ বছর পর ঋণ পরিশোধ শেষে সেতু বিভাগের মুনাফা অনেক বেড়ে যাবে।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, কমিটির সুপারিশসহ প্রতিবেদন এরই মধ্যে রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি তা অনুমোদন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। মন্ত্রণালয় অনুমোদন করলেই তা চিঠির মাধ্যমে বিবিএকে জানানো হবে। তারা যে জবাব দিবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং সেতু ও অর্থ বিভাগের মধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও আহ্বান করা হতে পারে।
প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে গত ২৫ জুন। তবে সেতুতে ট্রেন লাইন বসানোর কাজ শুরু হয়েছে গত মাসে। আগামী বছর মার্চে পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলাচল শুরুর কথা রয়েছে।