নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জনগণের বাসস্থানের নিশ্চয়তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে দ্রুত হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। প্রবৃদ্ধির এ হার এশিয়ার মধ্যে দৃষ্টান্ত হলেও গৃহঋণ প্রবৃদ্ধিতে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম এ দেশে।
গতকাল রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএম’র মিলনায়তনে ‘হোম লোন অব ব্যাংকস : ট্রেন্ড অ্যান্ড ইমপ্যাক্ট’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, দেশে প্রধানত অব্যাংকিং সূত্র থেকে গৃহ নির্মাণের অর্থায়ন হয়ে থাকে। ফলে এদেশে গৃহঋণের বিপুল বাজার সম্ভাবনা রয়েছে, যেখানে ব্যাংক ও আর্থিক খাত বিনিয়োগ করতে পারে। তবে ২০০৭-০৯ সালে আমেরিকার হাউজিং বাবলের ফলে ব্যাংক খাতের পতনের উদাহরণকে মাথায় রেখে ঋণদানে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে সূক্ষ্ম নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গৃহঋণের ৮০ শতাংশই দেওয়া হয় শহরাঞ্চলে। ফলে উপশহর ও গ্রামাঞ্চল গৃহঋণ সুবিধার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। তাই ওইসব এলাকায় গৃহঋণ বিতরণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণে এটিই উপযুক্ত সময়।
গোলটেবিল বৈঠকে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বিআইবিএম’র সহযোগী অধ্যাপক মো. মহিউদ্দিন সিদ্দিকী। তিনি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকসহ মোট ২৩টি ব্যাংকের নমুনা তুলে ধরেন। এতে দেখা গেছে, ২০০৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দেশের গৃহঋণ প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। তবে এ ঋণ গ্রহণে বন্ধকি সম্পত্তি ও জিডিপির অনুপাত মাত্র ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০১৫ সালের হিসাবে নেপালে এ প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৩, ভারতে ৮, চীন ১৭, থাইল্যান্ডে ১৯, মালয়েশিয়ায় ৩৭ ও সিঙ্গাপুরে ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশে ঋণ সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে রয়েছে বিশাল ব্যবধান।
এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আমাদের দেশে গৃহ অর্থায়নে শহর ও গ্রামের মধ্যে ঋণ বণ্টনের পার্থক্য অনেক বেশি। তবে এ ব্যবধান ক্রমশ কমছে। ২০০৬ সালে গ্রামে গৃহ ঋণদানের হার যেখানে ৫ শতাংশ ছিল, ২০১৬ সালে তা বেড়ে ১৭ শতাংশ হয়েছে। আর এ সময় শহরে ঋণদানের হার ৯৫ শতাংশ থেকে কমে ৮৩ শতাংশ হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ইদানীং ফ্ল্যাট কেনা অপেক্ষা বাড়ি নির্মাণে ঋণচাহিদা বাড়ছে। গৃহঋণে খেলাপি ঋণের হারও তুলনামূলক কম। ২০০৬ সালে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের হার ছিল ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ, তখন গৃহঋণে খেলাপি ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। কিন্তু গৃহঋণে তা মাত্র ৩ শতাংশ। সর্বোপরি গ্রাম ও শহর উভয় স্থানে গৃহঋণকে আকর্ষণীয় করে তুলতে দূরদর্শিতার সঙ্গে এবং সহজ শর্তে অভিনব পণ্য বাজারে আনার সুপারিশ করা হয়।
বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ২০০৭-০৯ সালে আমেরিকার হাউজিং বাবলকে কেন্দ্র করে মন্দঋণ বেড়ে যাওয়ার ঘটনাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কম ঝুঁকিতে জনগণের সামর্থ্যরে মধ্যে গৃহঋণকে নিয়ে আনার ব্যাংকগুলোর কাছে অনুরোধ রইলো।
বৈঠকে উপস্থিত স্টান্ডার্ড চার্টাড ব্যাংকের কান্ট্রি হেড আবরার আনোয়ার বলেন, এ দেশে গৃহঋণের সবচেয়ে বড় ঘাটতি হচ্ছে উচ্চ সুদের হার। ২৫ বছরের জন্য একজন গ্রাহককে নির্দিষ্ট একটি সুদহারে ঋণ নিতে হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় জিরো কুপন বন্ড হতে পারে।
গোলটেবিল আলোচনায় অংশগ্রহকারী ব্যাংকাররা তাদের মতামত রাখেন। ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব প্রোডাক্ট (হোম লোন) ইমরান পারভেজ বলেন, প্রবাসী বাঙালিরা গৃহঋণের উল্লেখযোগ্য গ্রহীতা হতে পারে। কিন্তু শর্ত ও প্রক্রিয়াগত জটিলতা প্রায়ই এদের ঋণগ্রহণে নিরুৎসাহিত করে। প্রবাসীরা যাতে সহজ প্রক্রিয়ায় ঋণ পেতে পারে সে ব্যাপারে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের ঋণদানে সুদের হার কম হয় আমানতের সুদহার কম হলে। আর আমানতের সুদহার কম হয় মূল্যস্ফীতি কম থাকলে। এটি একটি চেইন রিয়্যাকশন। সুতরাং গৃহঋণে সুদহার কমানোর জন্য মূল্যস্ফীতিকে কম রাখতে হবে আগে।
ওয়ান ব্যাংকের ডুকমেন্টশন হেড বলেন, অনেক সময় একই গ্রাহক সাত-আটটি ব্যাংকে ঋণের জন্য আবেদন করেন। ডুকমেন্টেশন জাল করে। এ ধরনের গ্রাহকদের ব্ল্যাকলিস্ট করা উচিত।
বিআইবিএম’র মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিআইবিএম’র সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমদ চৌধুরী, বিআইবিএম’র সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলী, সীমান্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুখলেসুর রহমান।
Add Comment