আ. ন. ম. মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: যানজট ঢাকাবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী, যা জনদুর্ভোগ ও ভোগান্তির কারণ। তা কম বেশি সবাই স্বীকার করার পরও হাতেগোনা কিছু ব্যক্তি এবং সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন ছাড়া তেমন কেউই বলছে না, এই যানজট নিরসনের উপায়। এই শহরে অনেক বছর ধরে বসবাস করলেও শহরের চেনা ও পরিচিত রাস্তাগুলো একেবারে অচেনা হয়ে গিয়েছিল। অনেকটা আশ্চর্যান্বিত হওয়া ও আঁতকে ওঠার মতো অবস্থা। যানজট যেন এই শহর থেকে বিদায় নিয়েছে। সড়কে ছিল না যান্ত্রিক যানবাহনের চাপ, ফলে ছিল না শব্দদূষণ। বায়ুদূষণ কমে গিয়েছিল বিগত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিন্ম পর্যায়ে। ফলে চিরচেনা ব্যস্ত রাস্তাঘাট রূপ নিয়েছিল ভিন্ন রকম ফাঁকা এক দৃশ্যপটে। এসব কারণে আশ্চর্যান্বিত না হওয়া বা আঁতকে না ওঠার কোনো ধরনের কারণ ছিল না।
বিগত এক দশকের বেশি সময় বাংলাদেশের পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনগুলো সড়ক দুর্ঘটনা (অপমৃত্যু), যানজট, শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ থেকে সবাইকে নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে অনেক চিৎকার ও আর্তনাদ (সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন, হ্যান্ডবিল বিতরণ, কর্তৃপক্ষকে চিঠি লেখা, পত্রিকায় নিবন্ধ লেখা) করেছেন। দুঃখের বিষয় একই জাতের মানুষ হলেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের কেউই এদিকে দৃষ্টিপাত বা কর্ণপাত করেনি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো ভিন্ন জাতের মানুষ হয়েও ইংরেজি সাহিত্যের সুবিখ্যাত কবি ও গদ্যলেখক রিচার্ড লুই স্টিভেনসন দীর্ঘদিন প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপ হাইতিতের থাকাকালে সেখানকার নিগ্রো অধিবাসীদের বিভিন্ন সমস্যার গল্প শোনাতেন, যারা ভিন্ন জাতির মানুষ। তারা খুব খুশি হয়ে রিচার্ড লুই স্টিভেনসনের নাম দিয়েছিল ‘টুসি টালা’ অর্থাৎ ঝঃড়ৎু ঃবষষবৎ। ওইসব কর্তৃপক্ষ কি জ্ঞানপাপী, নাকি মানসিক প্রতিবন্ধী ছিল, তা এখনও বুঝতে পারিনি। তবে কর্তৃপক্ষ কর্নপাত না করলেও শেষ পর্যন্ত এই চিৎকার ও আর্তনাদ ওপরের আদালতে পৌঁছেছিল, যার ফলে কভিড-১৯ প্রতিরোধে স্থানবিশেষে লকডাউন করায় শহরের যানজট, শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ কমে গিয়েছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক সারাদেশকে কভিড সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এসব কারণ একটাইÑকরোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) সংক্রমণ ও অপমৃত্যু ঠেকানো। কিন্তু সড়কে মানুষের অপমৃত্যু ঠেকাতে এরকম কোনো প্রকার কমিটি কখনও সরকার করেছিল কি? এটা করলে সহজে সড়কে হাজার হাজার নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষের অপমৃত্যু ঠেকানো যেত।
২০১১ সালে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ২০২০ সালের মধ্যে তাদের নিজ দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনবে বলে সম্মত হয়েছিল। সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার বাংলাদেশেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। যদি সরকার এ রকম কমিটি গঠন করে এবং যাতায়াতে রেলপথকে গুরুত্ব প্রদান করে শহরে ট্রাম ও অযান্ত্রিক যানবাহনের (রিকশা ও সাইকেল) মাধ্যমে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করলে সড়কে অপমৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যেত। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষণার তথ্যমতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে সড়কে প্রায় ১৫ হাজার নিরপরাধ মানুষের অপমৃত্যু হচ্ছে এবং পঙ্গু হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এগুলোকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব অপমৃত্যুর কারণে আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। মানুষের যাতায়াত নিরাপদ করার জন্য প্রয়োজন ছিল ‘নিরাপদ যাতায়াত আইন’ নিশ্চিত করা, কিন্তু দুঃখের বিষয় সরকার তা না করে করেছে ‘নিরাপদ সড়ক আইন’, যার কারণে সড়কে অপমৃত্যু, ছিনতাই, ধর্ষণÑকোনোটাই ঠেকানো যাচ্ছে না। নিরাপদ যাতায়াত আইন করে, তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ওইসব অপকর্ম ঠেকানো সম্ভব হতো।
মহামারি কভিড-১৯ প্রতিরোধে লকডাউনের আদেশ অনেকটা বিলাসী গল্পের মৃত্যুঞ্জয়ের সম্পত্তি খুড়ার পাওয়ার মতো বলা যায়। মৃত্যুঞ্জয়ের সম্পত্তি কোনো বাধা ছাড়াই খুড়া পেয়েছিল, দুনিয়ার কোনো আদেশে নয়, সরাসরি ওপরের আদালতের আদেশে। তাই বলা যায়, পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনগুলোর অধিকার বা চাওয়া কিছুটা পূর্ণ হয়েছিল, একেবারে সর্বোচ্চ আদালতের সরাসরি আদেশে। কভিড-১৯ লকডাউনের আদেশ বাতিলের পর ওই অবস্থা ধরে রাখাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষ এদিকে আন্তরিক সুদৃষ্টি না দেয়ার কারণে ঢাকা শহর আবারও যানজটে নাকাল। তীব্র যানজটের ভোগান্তিতে নগরবাসী এবং এর সঙ্গে সড়কে অপমৃত্যুর পরিমাণও বাড়ছে। প্রত্যেকে ভুক্তভোগী হলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং অপ্রতুল কার্যকর পদক্ষেপই সড়কে অপমৃত্যু ও যানজট সমস্যার জন্য প্রধানত দায়ী। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সত্তরের দশকের মতো বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ওই সময় থেকে জ্বালানি সংকট সমাধান করতে, জলবায়ু বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে এবং বায়ুদূষণ কমাতে এখন গাড়িমুক্ত শহর আন্দোলন সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন বিশ্বের প্রায় চার হাজার শহরে প্রতি বছর ২২ সেপ্টেম্বর এই ‘গাড়িমুক্ত দিবসটি’ পালিত হয়ে থাকে। ‘বিশ্ব গাড়িমুক্ত দিবস, ২০২২’-এর প্রতিপাদ্যÑ‘জ্বালানি, যানজট নিয়ন্ত্রণ করি, ব্যক্তিগত গাড়ি সীমিত করি।’
বাংলাদেশে ২০০৬ সাল থেকে (প্রায় দুই দশক আগে) বেশ কিছু সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে ‘গাড়িমুক্ত শহর দিবস’ আন্দোলন শুরু করে। তারপর ২০১৬ সাল থেকে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ’র) সার্বিক সহযোগিতায় বেশ কিছু সরকারি, বেসরকারি ও সামাজিক সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগে ‘বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস’ উদ্যাপন শুরু করে। যদিও ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রথম ধারণাটি পাওয়া যায় ‘দ্য ডেথ অ্যান্ড লাইফ অব গ্রেট আমেরিকান সিটিস’ বইতে। সাংবাদিক ও লেখক ইয়ান জ্যাকবসের লেখা বইটি ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। এই ধারণাই নগর পরিকল্পনায় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে ১৯৬২ সাল থেকে শহরে সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখে শুধু পথচারীদের জন্য উš§ুক্ত করা হয়। তার পর থেকে এই ধারাবাহিকতায় ইউরোপে এই ধারণাটির প্রচারের মাধ্যমে প্রসার ঘটতে শুরু করে। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সত্তরের দশকে জ্বালানি সংকট দেখা দিলে তা আরও ব্যাপকতা লাভ করে। সুইজারল্যান্ড ১৯৭৪ সালে গাড়িমুক্ত দিবস পালন শুরু করে এবং নব্বইয়ের দশকে এই উদ্যোগটি আন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর ফ্রান্স ১৯৯৮ সালে ২২ সেপ্টেম্বরকে ৩৪টি শহরে জাতীয়ভাবে গাড়িমুক্ত দিবস পালন শুরু করে, বর্তমানে এটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে।
বর্তমানে এই পরিস্থিতিতে জ্বালানি সংকট সমাধান, জলবায়ু বিপর্যয় রোধ, দূষণ হ্রাস, সড়কে নিরপরাধ মানুষের অকাল মৃত্যু ঠেকানো এবং যানজট নিরসনে বাংলাদেশে যাতায়াত ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সাইকেল। সাইকেল আধুনিক সভ্যতার আশীর্বাদ। অতীতকালেও যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের বাহন হিসেবে সাইকেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেটা বাইসাইকেল বা ট্রাইসাইকেলই হোক, দুটিই পরিবেশবান্ধব বাহন। এই দুটি বাহন ব্যবহার করতে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো লাগে না। জীবন ও জীবিকার জন্য মানুষ যখন শহর ও নগরমুখী হয়েছিল, তখন থেকে সাইকেলের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। যে দূরত্বে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করা অনেক সময়সাপেক্ষ, সেক্ষেত্রে যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে সাইকেল।
সাইকেল যে শুধু যাতায়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তা-ই নয়, পণ্য পরিবহনেও এই বাহনের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পায়ে হাঁটা পথে পাঁচ-দশ ঘণ্টার পথ, অনেক কম সময়ে কোনো ক্লান্তি ছাড়াই এরকম বাহন ব্যবহার করে যাতায়াত করা অনেক সহজ। পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির কোনো ধরনের ক্ষতি না করে এই বাহন ব্যবহার করা সম্ভব। কোনো ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা লাগে না সাইকেল ব্যবহার করতে, তাই জ্বালানি সংকট সমাধান করতে পারে সাইকেল। ফলে শহরের বায়ুদূষণ কমে আসবে এবং জলবায়ু বিপর্যয় রোধে ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এজন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানাই।
আইনজীবী
masumbillahlaw06@gmail.com