নিজস্ব প্রতিবেদক: বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎকারী প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের চারটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) পাওনা ২৬০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে তাদের বন্ধকী সম্পত্তির বিক্রয়মূল্য মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। তাই এসব প্রতিষ্ঠান বিক্রি না করে পুনর্গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএলএফএসএল। পিকের প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑরেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড, আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি এবং রহমান কেমিক্যালস লিমিটেড।
গতকাল বৃহস্পতিবার আইএলএফএসএলের ২৬তম বার্ষিক সাধারণ সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে আইএলএফএসএল’র পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান সাবেক সচিব মো. নজরুল ইসলাম খান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. মশিউর রহমানসহ পর্ষদের পরিচালক উপস্থিত ছিলেন।
তথ্যমতে, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৮০ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে পড়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নেই। তাই জামানতের সম্পদ বিক্রি না করে কোম্পানিগুলোকে পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। ইতোমধ্যেই হাইকোর্টের অনুমোদন সাপেক্ষে অনেকগুলো কোম্পানির পর্ষদ গঠন করে দেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ঋণ নিয়েছে পিকে হালদারের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। আমাদের প্রথম প্রচেষ্টা ছিল পিকে হালদারকে যদি আনতে পারি তাহলে তার কাছ থেকে এগুলো নেয়া সহজ ছিল। আর প্রক্রিয়ায় গেলে অনেক সময় লাগে। আর সে এমন কায়দায় ঋণ নিয়েছে সরাসরি ধরা কঠিন। কিন্তু তাকে এখনও আনা যায়নি। আগামীতে আনা যাবে কি না তা জানি না। এজন্য তার কোম্পানি রেস্টাইলস যেটা ভালুকায় আছে সেটা হাইকোর্টের আদেশ নিয়ে পর্ষদ পুনর্গঠন করেছি। চালু করে আয় করার চেষ্টা চলছে। কুমির চাষের এ প্রকল্প আশা করছি লাভজনক হবে।
তিনি বলেন, আর একটা কোম্পানি আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ। এটা খুবই ভালো মুনাফার কোম্পানি। ফিটকিরি কোম্পানি, অনেক কিছু চুরি করে নিয়ে গেছে লোকজন। আদালতের অনুমোদন নিয়ে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন হয়েছে। চেয়ারম্যান ও পরিচালক আছে। তারা চেষ্টা করছে এটা চালু করতে
পারে কি না। এটা যদি চালু করতে পারে, তাহলে প্রফিট হবে। এছাড়া রহমান কেমিক্যালস গ্লুকোজ তৈরি করে। সেটা আমরা অনুমতি পেয়েছি, কিন্তু বোর্ড এখনও পুনর্গঠন হয়নি। আর নর্দান জুট চালুর জন্য লোকজন খুঁজছি পুরনো ঋণ থাকলেও এর ওপর তাদের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হবে, এটা চালাবে এবং আমাদের কিছু টাকা দেবে।
এসব প্রতিষ্ঠান লাভজনক করতে কত দিন লাগতে পারে জানতে চাইলে আইএলএফএসএল চেয়ারম্যান জানান, এটা বলা যায় না। তবে দুই থেকে চার, পাঁচ বছর সময় গেলে যাবে। এটা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ ২৬০ কোটি টাকা ঋণের বন্ধকী সম্পত্তি ৩৬ কোটি টাকায় বিক্রি করে কোনো লাভ নেই বলে জানান তিনি।
এদিকে দুদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে চেয়াম্যান বলেন, আইএলএফএসএল আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে দুদক যে মামলা করেছে এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। দুদক যে মামলা করেছে, সেখানে মৃত ব্যক্তির নাম দিয়েছে। আবার এমনও কাজ করেছে কেলেঙ্কারির সময় বোর্ডে ছিল, ওই ব্যক্তির নাম এফআইআরে দেয়নি।
জানা গেছে, পিপলস লিজিংয়ের পাঁচ আমানতকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৫ জানুয়ারি পিকে হালদারের মা লীলাবতী হালদারসহ ২৫ জনের বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। ওই ২৪ জনের মধ্যে এন আই খান ছিলেন। পরবর্তী সময় নজরুল ইসলাম খানকে বিদেশ যাওয়ার ওপর হাইকোর্টের দেয়া আদেশ স্থগিত করেন আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্ট।
এ বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে নজরুল ইসলাম খান বলেন, হাইকোর্টের আদেশে আমাকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসর চেয়ারম্যান করা হয়। এ বিষয়ে আমি কিছু জানতাম না। আমার বিদেশ যাত্রার নিষেধাজ্ঞা চেয়ে দুদক যে মামলা করে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দুটি টেলিভিশনের টকশোতে দুদক আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খানের সঙ্গে আমার মতবিরোধ হয়। সে কারণে ব্যক্তি আক্রোশের কারণে এ মামলা করা হতে পারে।
তিনি বলেন, আপনারা দেখেছেন দুদক যে এফআইআর করেছে, সেখানে মৃত ব্যক্তির নাম আছে। আবার এমন ব্যক্তি আছে বোর্ডে আছেন কিন্তু এফআইআরে তার নাম নেই। এফআইআরে যে মৃত ব্যক্তির নাম আছে, তিনি কে? সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আপনারা খুঁজে বের করেন। আমি বলব না। তবে আমি বলছি এফআইআরে মৃত ব্যক্তির নাম আছে।
তিনি আরও বলেন, ২০-৩০টা মামলা করে এর মানে কনফিডেন্স নেই ধরতে পারব কি পারব না। একটা করতে হবে একদম টাইট দিয়ে, দুইটা করতে হবে টাইট দিয়ে, তিনটা করতে হবে টাইট দিয়ে। ৩০টা মামলা করা লুজ।
আপনি বলছেন, হাইকোর্ট আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছে, আপনি কিছুই জানতেন না, আবার হাইকোর্ট থেকেই আপনার বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। তাহলে এটা কী স্ববিরোধী হয়ে গেল না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে উত্তরে তিনি বলেন, দুটি দুই কোর্ট। আবার দুদক যে দরখাস্ত করেছে সেখানে নাম আর বাবার নাম লিখেছে। এখানকার (ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস) চেয়ারম্যান উল্লেখ করেনি।
আমানতকারীদের পাওনা কীভাবে পরিশোধ করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা প্রথমে যাদের কম টাকা আমানত তাদের প্ররিশোধ করা শুরু করেছি। অর্থাৎ নিচ থেকে দেয়া হচ্ছে। নতুন বোর্ড আশার পর এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৬৫২ জন আমানতকারীকে ১৩৯ কোটি টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫২ জনের পুরো টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যারা সুদ ছাড়া নিতে রাজি হচ্ছে তাদের আগে দেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে অন্যদেরও দেয়া হবে। তবে আমাদের প্রাথমিক চেষ্টা আমানতকারীদের আস্থা ফেরানো।
আইএলএফএসএল এমডি মশিউর রহমান প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা তুলে ধরে বলেন, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সামগ্রিক ব্যয় ২১ শতাংশ কমেছে, সুদের আয় প্রায় একই পর্যায়ে ছিল। তবে তা বাড়বে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে আমাদের ৭০ শতাংশ সামগ্রিক ক্ষতি কমানো হয়েছে। তাই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ও এর গতিশীলতা ত্বরান্বিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।