মেহেদী হাসান: কয়েকদিন আগে রাজশাহীর বেসরকারি এক হাসপাতালে গিয়েছিলাম রোগী দেখাতে। নামকরা ওই ডাক্তারের কাছে ৪৪ নম্বর সিরিয়াল পেলাম। আমার নম্বর পেতে সময় লাগবে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা।
তবে ১০০ টাকা ঘুষ দিলে আগে হয়ে যায়! ভাবলাম, এভাবে সুবিধা নিলে অপরের প্রতি অন্যায় হবে। অথচ চোখের সামনেই সেই সুযোগ আরেকজন নিলেন!
সমাজে যেন পরস্পরের স্নায়ুবিক যুদ্ধ চলছে। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়। ৯৯ শতাংশ রোগী মনে করেন, ডাক্তাররা অমানবিক, কসাই। টাকা পেলেই হলো একগাদা টেস্ট, মুদি দোকানের মতো লম্বা ওষুধের ফর্দি হাতে ধরিয়ে কমিশন খাওয়া ইত্যাদি ডাক্তারের রুটিনের মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে ডাক্তাররা মনে করেন, রোগীরা সবচেয়ে অভদ্র, অশিক্ষিত, সম্মানবোধ নাই। নি¤œ শ্রেণির এসব ইতরদের বেঁচে থাকার জন্য টাকা নিয়ে ওষুধ লিখে উপকার করছি এটাই বেশি।
দোষারোপের ক্ষেত্রে অন্ধ আনুগত্যের দিকে আমরাই এগিয়ে। পাড়ার চায়ের দোকানে বসে কেউ একজন বললেন, ডাক্তাররা তো টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। একেকটা শকুনের মতো মানুষের চামড়া খুলে খায়। পাশেরজন কোনোদিন বড় ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে আসেননি কিন্তু কথার স্ফুরণÑএকদম ঠিক বলেছিস।
শুধু ডাক্তার রোগীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে নয়। ছাত্ররা মনে করে স্যাররা কঞ্জুস। পরীক্ষায় ভালো লিখেও হিংসা করে নম্বর দেন না। আবার স্যাররা মনে করেন ছাত্ররা তো ঘুরে বেড়ায় পড়াশোনা ফাঁকি দিয়ে। বাড়িওয়ালা মনে করে, ভাড়াটিয়া তো প্রত্যেকটা বেয়াদব। একটু কিছু হলেই মালিকের সঙ্গে গণ্ডগোল পাকিয়ে মারতে আসে। আবার ভাড়াটিয়ারা মনে করেন, বাড়ির মালিক একেকটা বাচ্চা। টাকা ছাড়া কিছু বোঝেন না। মানুষের চামড়া গায়ে লাগানো নেই। আছে গণ্ডারের চামড়া। আবেগ অনুভূতির বালাই নেই। রাস্তায় প্রত্যেকটা রিকশাচালককে লোভী, অশিক্ষিত, চাষা মনে করেন প্যাসেঞ্জার। আবার রিকশাওয়ালাও মনে করেন, প্রত্যেকটা প্যাসেঞ্জার একটা অমানুষ। একবার ভাড়া দিয়ে নেমে যাবে তার সঙ্গে ভালো আচরণের কী প্রয়োজন!
এসব বিষয় কখনোই ছোট নয়। আদিকালে সমাজের যে বৈশিষ্ট্য নিয়ে সমাজ গঠন হয়েছিল, তা ক্রমাগত ভাঙছে। একজন অপরজনকে সহানুভূতির দিকে তাকাতে রাজি নয়। ধৈর্যের মাত্রা কচুপাতার পানির মতো হয়ে গেছে। দোষারোপের রাজনীতি, ক্ষমতা দখলের অপ্রয়াস, পারিবারিক বন্ধনে দুর্বলতা, আত্মীয়তার সম্পর্কে ফাটলÑএসব মূলত ছোট ছোট আমাদের আচরণের ফল। বাজারে গরিব সবজিওয়ালাকে এক টাকা বেশি দিলে আমার তেমন ক্ষতি হবে না। কিন্তু এক টাকার জন্য একজন রিকশাওয়ালার গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিতে আমরা খুবই পটু। একই মানুষ ১২ টাকায় এক শলাকা সিগারেট খেতে ভাবে না, এটা অপচয়।
আমরা সবাই মনে করি, সবাই খারাপ শুধু নিজেরা ভালো। ৮ টাকা পিসের ডিম ১০ টাকা কেন হলো তা নিয়ে মাথাব্যথার শেষ নেই। সরকারের ব্যর্থতা, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের দায়িত্বহীনতা, খামারিদের সিন্ডিকেটসহ নানান কথা বলছি। কিন্তু মুরগি যে খাবার খেয়ে ডিম পাড়ে সেই ১ হাজার ৮০০ টাকার ৫০ কেজির খাদ্যের বস্তা দাম বেড়ে এখন ৩ হাজার ৪০০ টাকা হয়েছে তার খোঁজ কিন্তু কেউ নিইনি।
জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল আমাদের পরিবার থেকে শেখানো হয়। কপটতা, ভণ্ডামি শেখানো হয় পরিবার থেকে। শিশু তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে এটা হয় না কেন, ওটা হয় না কেন? বাবার উত্তর ওটা ওমুক সরকারে করে গেছে, ওমুক এটার জন্য দায়ী। নিজের সন্তানকে সত্য বলার সাহস নেই। ১০০ প্রশ্ন করলে সবগুলোর জন্য দায়ী কেউ না কেউ? নিজে একটিরও দ্বায়ভার নিতে রাজি নয়। ফলে বেড়ে ওটা সমাজের কর্ণধাররা এই ভণ্ডামি শিখেই বড় হচ্ছে। শুনে কথার যাচাই ছাড়া বিশ্বাস আর সেটা প্রচারের জন্য হ্যাঁতে হ্যাঁ মেলানো স্বভাবে পরিণত হয়েছে।
এরাই আত্মবিশ্বাসী হতে পারে না। সমাজের মানুষ সম্পর্কে ক্রমাগত নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে থাকে। আর এভাবেই চলে তাদের বেড়ে ওঠা। সমাজ ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছেÑএটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তার নিয়ন্ত্রণ ও শুভ বুদ্ধির উদয় ঘটানোর দায়িত্ব কিন্তু আমাদের হাতে। তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইন ও বিচারের সামঞ্জস্য কাঠামো, ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করা, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কাউন্সিলসহ হতে পারে রাষ্ট্রীয়ভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সবার আগে নিজেরটুকু প্রিয় তালিকায় রেখে এটা করা সম্ভব নয়।
ডাক্তার নির্ধারিত ভিজিট নেবেন, তাতে অন্যায়ের কিছু নেই। তবে সিরিয়ালের জন্য বাড়তি টাকা দিতে হবে কেন। তেমনই সব কাজে বিশেষজ্ঞ না হলেও ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায় বিচার করে তার শুভটা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাতেই সমাজের অর্ধেক খারাপ ভালো হবে। বাকিটা ঠিক করতে সময় নিতে হবে, সেটাও হবে। তা সাধারণ মানুষই ঠিক করবে।
শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ