আ. ন. ম. মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, তাই মানুষ চিন্তা করতে পারে। চিন্তা করা মানুষের মৌলিক গুণ হলেও অনেকেই এই গুণকে আনন্দের সঙ্গেই উপেক্ষা করেছেন। এজন্য সমুদয় মানুষ যুগ যুগ ধরে এই গুণটি তেমন করে কাজে লাগায়নি। তবে পৃথিবীর সব মানুষ একসঙ্গে আবদ্ধ চিন্তার হতে পারে না। তাই যুগে যুগে কিছু মানুষ হেঁটেছেন বিপরীত পথে। তারা বাস্তবিক চিন্তার অনুশীলন নিজেরা করেছেন এবং ছড়িয়েছেন মানুষের কল্যাণে। ফলে পৃথিবী হাঁটতে পেরেছে প্রগতির পথে। তবে এই চিন্তক মানুষেরা জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সুরক্ষা ও উন্নয়ন বিষয়ে কথা বলে নিগৃহীতও হয়েছেন অনেক। তারপরও তারা থেমে কখনও থাকেননি। এজন্য চিন্তাশীল মানুষকে সম্পদ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে, সম্পত্তি হিসেবে নয়। সম্পত্তি বিক্রি ও বিপণন করার মতো বিষয় হলেও সম্পদ বিক্রি বা বিপণন করার মতো বস্তু নয়। আর সেই সম্পদটি যদি হয়, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ (আশরাফুল মাখলুকাত) তখন এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। কিন্তু তামাকজাত পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবসা জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি ও জীবনের ঝুঁকিমূলক কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
তামাকজাত পণ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি, কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রদান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্যও অন্যতম দায়ী। এককথায় প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের ‘ওলা বিবির’ রূপ ধারণ করেছে। হাতে গোনা কিছু অর্বাচীন ব্যক্তির কারণে রাষ্ট্রের প্রচলিত বেশি কিছু আইন থাকার পরও তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। ওইসব ব্যক্তি তামাক উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার দাবি করা বাদ দিয়ে, কেউ সারচার্জ দাবি করছে; আবার কেউ তামাক ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স দেয়ার দাবি করছে। তাদের জ্ঞানস্বল্পতার জন্য তারা এই দাবি করছে বলে অনেকই মনে করেন। তা-ই নয় কি? মানুষকে সমূলে বিনাশ করা মানবতাবিরোধী অপরাধ, যার বিচারকাজ নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এজন্য মানুষকে সমূলে বিনাশ ও ধ্বংসকারীদের কাছ থেকে রাজস্ব চাওয়া কখনোই যৌক্তিক দাবি হতে পারে না। তাছাড়া মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, নিরপরাধ মানুষ হত্যাকারীদের লাইসেন্স কেন? এছাড়া মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আর ‘গাছের প্রাণ আছে’ বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু তা অনেক বছর আগেই প্রমাণ করেছেন। তামাক কোম্পানিগুলো তামাক চাষ করতে গিয়ে নদী ও বনভূমিকে হত্যা করছে। এজন্যই নিরপরাধ মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতি হত্যাকারীদের লাইসেন্স প্রদানের তীব্রভাবে নিন্দা জানাই। অর্বাচীন লোকজনের উদ্দেশে প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও লেখক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী রচিত ‘মানুষ মুহাম্মদ (স.)’ প্রবন্ধের ব্যক্ত উক্তিটি বলতে চাইÑ‘এদের জ্ঞান দাও প্রভু, এদের ক্ষমা করো।’
কারণ তার আগেও অর্বাচীন কিছু লোকজন নিরাপদে যাতায়াত অনিশ্চয়তার কারণে ‘নিরাপদ যাতায়াত আইন’ করার জন্য আইন পাস করার দাবি না করে, নিরাপদ সড়ক আইন পাস করার জন্য সরকারের কাছে দাবি করছে। ফলে সরকার নিরাপদ যাতায়াত আইন পাস না করে, নিরাপদ সড়ক আইন পাস করেছেন। এ কারণে সড়কে নিরপরাদ মানুষের অপমৃত্যু ঠেকানো তো যাচ্ছেই না, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপমৃত্যু, ধর্ষণ ও ছিনতাই আরও বাড়ছে। যেহেতু অর্বাচীন কিছু লোকজন দাবি করছিল নিরাপদ সড়ক আইন। কিন্তু সরকারের কাছে আমাদের দাবি করা উচিত ছিল নিরাপদ যাতায়াত আইন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অর্বাচীন ওই লোকজনের কারণে জীবন হুমকিতে পড়ছে। আগেও ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি না করার কারণে সরকার পাস করেছে নিরাপদ সড়ক আইন। এখনও ন্যায্য দাবি না করার কারণে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের হুমকিতে পড়ছে। তামাকজাত পণ্য পরিবহনে যান্ত্রিক যানবাহনগুলোয় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতার কারণে জলবায়ুর ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। তাই এখনই ন্যায্য দাবি করা ও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করার জন্য রাষ্ট্রকে চাপ প্রয়োগ করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে ধর্ষণকারী, ছিনতাইকারী, পরিবেশ ধ্বংসকারী, চোর, ডাকাত ও দুর্নীতিবাজরা বলার সুযোগ পাবে, ‘আমরা সরকারকে সারচার্জ ও কর দেব। আমাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রচলিত ফৌজদারি আইনের প্রয়োগ করবেন না।’ এতে আপনি আশ্চর্য হবেন কি, তা ভেবে দেখা দরকার।
পুলিশ হেফাজতে মানুষের অপমৃত্যু হলে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করে ফৌজদারি অপরাধের আওতায় আনায় হয়, তাহলে রাষ্ট্রের হেফাজতে নিরপরাধ মানুষের অপমৃত্যু হচ্ছে, সেজন্য তামাক কোম্পানিগুলো দায়ী হবে না কেন? গাড়ি দিয়ে মানুষ হত্যা যদি ফৌজদারি অপরাধ হয়, তাহলে তামাক দিয়ে মানুষ হত্যা কেন ফৌজদারি অপরাধ নয়? তামাক ব্যবসা করার ফলে কার লাভ, কার ক্ষতি, তা ভেবে দেখা দরকার? প্রতিবছর বাংলাদেশে এক লাখ ৬১ হাজার নিরপরাধ (সৃষ্টির সেরা জীব) মানুষকে অযৌক্তিক কারণে হত্যা করেছে তামাক কোম্পানিগুলো, যা দণ্ডবিধি, ১৮৬০ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। ১৯৯৯ সালে প্রফেসর নুরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ সরকার (রিট পিটিশন নং-১৮২৫/১৯৯৯) [২০ বিএলডি (এইসসিডি) ২০০০ (৩৭৭-৪০৪)] মামলার রায়ে কোথায়ও বলা হয়নি তামাক নিয়ন্ত্রণের কথা। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে যুক্তিসংগত সময় বেঁধে দিতে। ২৫ বছর কি যুক্তিসংগত সময় নয়? রাষ্ট্রের প্রচলিত এত আইন থাকার পরও বাংলাদেশ তামাকমুক্ত হোক যারা চায় না, তারাই রাষ্ট্রের স্থায়িত্বশীল উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
এই ফৌজদারি অপরাধ বন্ধের জন্য এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য যতটুকু সোচ্চার হওয়ার কথা বাস্তবে ততটাই সোচ্চার নয় রাষ্ট্র। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে হাতেগোনা কিছু ব্যক্তির (জেনারেল পার্সন ও লিগ্যাল পার্সন) তামাক পণ্যের দামের ওপর কর ও সারচার্জ দাবি। কর ও সারচার্জের অর্থ সরকারকে দেবে কেÑভোক্তা, নাকি তামাক কোম্পানি? প্রতিবছর বাজেটে তামাকজাত পণ্যের যে মূল্যে এবং কর বাড়ানো হয়, এতে তামাক কোম্পানিগুলো বরাবরই নিরপরাধ মানুষের অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ছে। তামাকের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ অন্যতম একটি কার্যকর উপায় হতো তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে, যদি কর বা সারচার্জের অর্থগুলো শুধু তামাক কোম্পানি প্রদান করত। কারণ সবার জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, বাংলাদেশে করকাঠামো শুধু (অ্যাডভ্যালুরাম-অফ াধষড়ৎবস) পদ্ধতিতে করারোপ করা হয়, মূলত যার প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি কর ও সারচার্জের অর্থ ভোক্তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে তামাক কোম্পানি। এই সংগ্রহ করা (কর ও সারচার্জ) অর্থ ভোক্তাদের কাছে থেকে তামাক কোম্পানিগুলো সরকারের কাছে জমা দিতে থাকে মাত্র। এতেই বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই; তামাক কোম্পানিগুলো নিরপরাধ মানুষ অকালে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং নদী ও বনভূমিকে ধ্বংস করছে, এর সঙ্গে হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে হাতিয়ে নিচ্ছে। এতেই বুঝতে পারেন তামাক কোম্পানির লাভ, কিন্তু রাষ্ট্রের চরম ক্ষতি হচ্ছে। কারণ মানুষ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য সম্পদ।
তামাকজাত পণ্যের ব্যবহারে জনস্বাস্থ্য ও মানুষের জীবনের ঝুঁকি আছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও চিকিৎসার বিজ্ঞানের তথ্য অনুসারে। এ তথ্য তামাক কোম্পানি জ্ঞাতসারে জানে। তাই তামাকজাত কোম্পানিকে ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা যায়। তামাক কোম্পানি প্ররোচনার মাধ্যমে মানুষের শরীরে রোগের বিস্তার ঘটাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়Ñতামাক চাষ করতে বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে, আবার তামাক শুকানোর জন্য গাছপালা কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তামাক কোম্পানি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে হুমকিতে ফেলছে। মানুষকে হত্যাসহ ওইসব কার্যক্রম করা রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বটে। কিন্তু লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে তামাক কোম্পানি দায়মুক্তি পায় কীভাবে? তামাক কোম্পানিকে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না কেন? তামাক কোম্পানির বিরুদ্ধে সিভিল ও ক্রিমিনাল লায়াবিলিটি আনতে বাধা কোথায়? যেখানে কমন ‘ল’ ব্যবস্থায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘আইন অজ্ঞতা কাউকে ক্ষমা করে না।’ এজন্য ফৌজদারি অপরাধের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে থেকে রাষ্ট্রকে বের হয়ে আসতে হবে।
তাই আমাদের কোনটা দাবি করা উচিত ও দরকারÑকর ও সারচার্জ, নাকি তামাক কোম্পানিগুলোকে শাস্তির আওতায় আনা এবং এর সঙ্গে সঙ্গে তামাক উৎপাদন, বিক্রি, বিপণন, সরবরাহ, পরিবহন প্রভৃতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি উত্থাপন করা সরকারের কাছে। এটাই বড় প্রশ্ন। একসময় ব্রিটেন সম্পর্কে এমনটা বলা হতোÑ‘দ্য এম্পায়ার অন হুইচ সান নেভার সেটস (যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য কখনও অস্ত যায় না)।’ এটা বর্তমান বাস্তবতায় সত্য নয়। ৯ অক্টোবর ‘জাতীয় তামাকমুক্ত দিবসে’ একটাই প্রত্যাশাÑসবাই তামাক কোম্পানির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন প্রয়োগের জন্য চাপ প্রয়োগ করুন। রাষ্ট্র যদি আন্তরিকতার সঙ্গে প্রচলিত আইন প্রয়োগ করে, তবে বাংলাদেশে তামাক কোম্পানির সূর্য অস্তমিত হবে। এজন্য দরকার রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তাই নিরপরাধ মানুষ হত্যার জন্য তামাক কোম্পানিকে ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ অনুসারে দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এ সংশ্লিষ্ট ধারায় শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
আইনজীবী
masumbillahlaw06@gmail.com