আলাউদ্দীন শাহরিয়ার, বান্দরবান: বান্দরবানে ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবে মেতে উঠেছে মারমা জনগোষ্ঠীসহ পাহাড়িরা। রং-বেরঙের শত শত ফানুসের আলোয় বর্ণিল এখন বান্দরবানের রাতের আকাশ। যেন রং লেগেছে পাহাড়ে। ‘ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে, গো ক্রোছোবায়া পাঁইনা পাপকনা’Ñ মারমা ভাষায় এ গানের সুরের তালে মাতাল হয়ে উঠেছে পাহাড়ি পল্লিগুলো। মারমা তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে শোভা পাচ্ছে এখন গানের এই সুর।
তিন মাস বর্ষাবাস (উপুস) থাকার পর বান্দরবান জেলায় ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবে মেতে উঠে পাহাড়ের জনগোষ্ঠী। ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে হচ্ছে মারমা জনগোষ্ঠীর অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। উৎসবকে ঘিরে বান্দরবান জেলায় পাহাড়ি পল্লিগুলো সেজেছে নতুন সাজে। চলছে নানা অনুষ্ঠানমালাও। এ উৎসবে আকাশে উড়ানো হয় রং-বেরঙের শত শত ফানুস বাতি। ফানুসের আলোয় এখন বর্ণিল হয়ে উঠেছে বান্দরবানের রাতের আকাশ। প্রচলিত আছে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধ এ আশ্বিনী পূর্ণিমায় তার মাথার চুল আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই আশ্বিনী পূর্ণিমার এই তিথিতে আকাশে উড়ানো হয় রং- বেরঙের ফানুস বাতি। এই উৎসবে পাহাড়ের মারমা জনগোষ্ঠীরা নিজস্ব সামর্থ্য অনুযায়ী ফানুসবাতি বানিয়ে আকাশে উড়িয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধকে স্মরণ করা হয়। মারমা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস: আকাশে ওঠার আগেই যে ব্যক্তির ফানুস মাটিতে পড়ে যায়, তাকে পাহাড়িরা পাপী লোক হিসেবে চিহ্নিত করে। ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবে ফানুস উড়িয়ে পাহাড়িরা নিজেদের পাপ মোচন ও পাপী মানুষ খুঁজে বের করে। এ কারণে ফানুস আকাশে উড়ানোর সময় পাহাড়িরা মারমা ভাষায় ‘সাও দো’ ‘সাও দো’ বলতে থাকে। অর্থাৎ শুভ মুক্তি। উৎসবে মাতোয়ারা মারমা তরুণী থুইয়ে থুই মারমা ও একেনু মারমা বলেন, ওয়াগ্যোই পোয়ে মারমা জনগোষ্ঠীর প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলোর অন্যতম। এ উৎসবে আমরা বৌদ্ধ বিহারে মানবজাতির শান্তি কামনা এবং অন্ধকার ও অশুভশক্তি দূর করতে হাজারো প্রদ্বীপ জ্বালায়। ধর্ম দেশনা ও প্রার্থনা করা হয়। উৎসবে সকাল বেলায় দূর-দূরান্ত থেকে বিহারের ধর্মীয় গুরু ভিক্ষুদের জন্য তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোর এবং নারী-পুরুষেরা মিলে ছোয়াইং নিয়ে যায়। পুণ্যের জন্য ভিক্ষুদের মাঝে দান করি মিষ্টি খাবার, নগদ অর্থ ও কাপড়।
তরুণী উমেচিং ও রিয়া মারমা বলেন, উৎসবে আমরা অনেক মজা করি। পাহাড়ি পল্লিগুলোয় রাতব্যাপী চলে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা। তরুণ-তরুণীরা দলবেঁধে বসে হরেক রকমের তৈরি করা পিঠা ধর্মীয় গুরু এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতে বিতরণ করি। চলে নিজস্ব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালাও। নাচে-গানে উৎসব মাতিয়ে তোলেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিল্পী তরুণ-তরুণীরা। রাজবাড়ি মাঠে চলে সুর আর ছন্দের এ প্রতিযোগিতা। উৎসব দেখতে ঢল নামে পাহাড়ি-বাঙালি হাজারো মানুষের। বেড়াতে আসা পর্যটকেরাও ভিড় জমান উৎসবে।
ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসব উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শৈটিং ওয়াই মারমা বলেন, উৎসবের মূল আকর্ষণ হচ্ছে মঙ্গল রথযাত্রা। স্বর্গীয় সুন্দর দেবতার মুর্তির আদলে তৈরি করা বিশাল আকৃতির ময়ূর রথের ওপর একটি বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করে রথটি রশি দিয়ে টেনে টেনে পুরো জেলা শহর ঘোরানো হয়। এ সময় বৌদ্ধ ধর্মের নর-নারীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বুদ্ধমূর্তিকে। রাতের এ রথযাত্রা দেখার জন্য রাস্তর দুপাশে ভিড় জমে। ফানুস ওড়ানোর মাধ্যমে আরম্ভ হওয়া ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় গত রাতে সাঙ্গু নদীতে মঙ্গলরথ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। তবে মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও পাহাড়ি পল্লিগুলোতে উৎসব চলবে মাসজুড়েই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জেলা বান্দরবান। এখানে উৎসব মানেই হচ্ছে পাহাড়ি-বাঙালি ভিন্ন ভাষাভাষির প্রায় চৌদ্দটি জনগোষ্ঠীর মানুষের মিলনমেলা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্ম যার যার, কিন্তু উৎসব হচ্ছে সবার। পাহাড়ের উৎসবে জাতি ধর্ম বর্ণ কোনো ভেদাভেদ নেই। এই আশ্বিনী পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধ তার মাথার চুল আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিল। তাই বুদ্ধের স্মরণে এ উৎসবে আকাশে উড়ানো রং-বেরঙের শত শত ফানুস বাতি। পাহাড়ের বৈচিত্র্যময় এ উৎসব দেখতে ভিড় জমান দেশি-বিদেশি পর্যটকরাও। এটি পাহাড়ের প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়। ফানুস ও হাজারো প্রদ্বীপ প্রজ্বালনের আলোয় দূর হোক অন্ধকার ও অশুভ শক্তি। শান্তিময় জীবন হোক বিশ্ববাসীর এই কামনা করি।